হজ ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয়ের নেপথ্যে
চলতি বছর দেশের হজযাত্রীদের হজ ফ্লাইট শুরু হয়েছে ২৪ জুন। হজ পালন করতে সৌদি আরবে যাবেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমান বহন করবে মোট ৬৩ হাজার ৫৯৯ জন যাত্রী। বাকিরা যাবেন সৌদিয়া এয়ারলাইনসে। শেষ ফ্লাইট ২৮ আগস্ট। এর মধ্যে গত রোববার পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৮৭৯ জনের ভিসা পাওয়া গেছে। ৬৫ হাজার ১২ জনের ভিসার আবেদন সৌদি দূতাবাসে জমা রয়েছে। অবশিষ্ট ৭ হাজার ১৩৩ জনের ভিসার আবেদন এখনো জমাই পড়েনি। মোট হজযাত্রীদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যেই সৌদি আরব পৌঁছেছেন মাত্র ৩৯ হাজার ২৪৮ জন। অর্থাৎ এখনো হজে যেতে বাকি ৮৭ হাজার ৯৫০ জন।
অথচ এরই মধ্যে নানা জটিলতায় যাত্রী সংকটের কারণে বাতিল হয়েছে বিমান ও সৌদিয়া এয়ারলাইনসের ২০টি ফ্লাইট। হাতে আছে আর মাত্র ২১ দিন। এর মধ্যে ৭০ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রীর ভিসা পেতে হবে। দুই এয়ারলাইনসকে বহন করতে হবে ৮৭ হাজার ৯৫০ হজযাত্রীকে। কিন্তু এত অল্প সময়ে ভিসা সংগ্রহ ও অবশিষ্ট যাত্রীদের বহন–এই দুই এয়ারলাইনস কতটা পেরে উঠবে, শঙ্কা দেখা দিয়েছে তা নিয়ে। ফলে এ বছর কমপক্ষে ৩৯ হাজার হজযাত্রীর শেষ পর্যন্ত হজে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ভিসা জটিলতায় রয়েছেন ৩১ হাজার ও বাকি ৮ হাজার যাত্রী রয়েছেন ফ্লাইট শঙ্কায়।
এর আগে গত বছরও দেশের হজ ব্যবস্থাপনায় এমন বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। হজযাত্রায় এমন বিশৃঙ্খলা ছিল গত বছরও। তখনো যাত্রী স্বল্পতায় প্রথম ১২ দিনে ১০টি হজ ফ্লাইট বাতিল হয়। হজে যেতে ইচ্ছুক ১ লাখ ১ হাজার ৭৫৮ জনের মধ্যে ভিসা হয় মাত্র ৬৫ হাজার জনের। শেষ পর্যন্ত বিমান ও সৌদি এয়ারলাইনস যাত্রীবহনে সক্ষম না হওয়ায় ৪০ হাজার জন হজে যেতে পারেননি।
অর্থাৎ প্রতি বছরের মতো এবারও হজযাত্রা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা বিশৃঙ্খলা। গত বছরের মতো এবারও হজ পালনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কোটা বাণিজ্য, ভিসা, সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া, খাওয়া, জিয়ারত, বিমান ভাড়াসহ প্রতিটি পদে পদেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ধর্ম মন্ত্রণালয় হজ নিয়ে বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি করলেও জটিলতা কাটছে না। মন্ত্রণালয় ও হজ অফিসের একেক সময় একেক সিন্ধান্তে এবারও চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে হজযাত্রীদের। অব্যবস্থাপনার জন্য পরস্পরকে দুষছে বিমান কর্তৃপক্ষ, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা হাব। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও দেখা দিয়েছে সমন্বয়হীনতা। এক অফিসের নির্দেশনা অন্য অফিস মানছে না। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হজ ফ্লাইটের শিডিউল করা অনেক হজযাত্রী এখনো ভিসা পাননি। নির্ধারিত ফ্লাইটে যেতে পারছেন না তারা। লাগেজ নিয়ে হজক্যাম্পে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন নিবন্ধিত হজযাত্রীরা।
এ নিয়ে স্বয়ং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ভিসা জটিলতা ও মোয়াল্লেম ফিসহ বিভিন্ন কারণে হজযাত্রীরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশ বিমানে ১৭৭টি ফ্লাইটের মধ্যে ৯টি হজ ফ্লাইট এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে। ফ্লাইট বাতিল হওয়ার কারণে পরের দিকে বিমানে যাত্রী পরিবহনের চাপ বাড়বে। এ ছাড়া ৮৫ হাজার যাত্রীর পাসপোর্ট এখনো হাতে পায়নি হজ অফিস। এসব সমস্যা বিমানের নয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হজ এজেন্সিগুলোর জটিলতায় এ সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি প্রায় ৪০ হাজার হজযাত্রীর সৌদি আরব-যাত্রা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল জলিল বলেন, ‘সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা করে সংকট সমাধানের চেষ্টা করছি। আশা করছি শেষ পর্যন্ত সব যাত্রীকেই হজে পাঠাতে পারব। তবে আমরা আগে জানলে দুই হাজার রিয়ালের বিষয়টি প্যাকেজে যুক্ত করতাম। এ ধরনের কোনো চিঠি তখন মন্ত্রণালয়ে আসেনি।’ একইভাবে শেষ পর্যন্ত সব যাত্রীই হজে যেতে পারবেন বলে আশা করছেন হাব মহাসচিব শাহাদত হোসেন তসলিম। তিনি বলেন, প্রতি বছরই হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। ফ্লাইট বাতিল হয়। তবে এ বছর যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে সেটি মূলত দুটি কারণে–আকস্মিক ২০০ রিয়াল যুক্ত করা ও সৌদি আরবের ই-ভিসা চালু করা। তবে সেগুলোরও সমাধান হচ্ছে।
৪০ হাজার হজযাত্রীর হজে যাওয়া নিয়ে যে সংশয়, তা সঠিক নয় বলে মত দিয়েছেন এই হজ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, যে ফ্লাইটগুলো এখন পর্যন্ত বাতিল হয়েছে, সেখানে যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র আট হাজার জন। সেটিও সমস্যা না। কারণ বিমান কর্তৃপক্ষ আরো ২০টি ফ্লাইটের অনুমতি পাচ্ছে। সেটি হলে সমস্যা থাকবে না।
এ বছর হজযাত্রা নিয়ে এমন বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে অবশ্য সংশ্লিষ্টরা দুটি মূল কারণের কথা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধর্ম মন্ত্রণালয় ও বিমান এয়ারলাইনসের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার মতে, সরকারের দুই প্রতিষ্ঠান ধর্ম মন্ত্রণালয় ও বিমান এবং হাবের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ইচ্ছে করেই হজ অব্যবস্থাপনা তৈরি করেছে। তারা চাইছে নানা জটিলতা তৈরি করে মূলত বিমান এয়ারলাইনসের হজ ফ্লাইট বাতিল করতে। এর ফলে শেষ দিকে হজযাত্রীদের থেকে টিকিটপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করবে। সে হিসেবে হাতিয়ে নেবে অতিরিক্ত ৫০-৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাতিল হওয়া হজ ফ্লাইটগুলো পরিচালনার মাধ্যমে সৌদি এয়ারলাইনস একচেটিয়াভাবে সব ভাড়া পাবে। সে হিসেবে বিমানের লোকসান গুনতে হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এসব কর্মকর্তা এমনও বলেন, এসব অর্থ এই সিন্ডিকেটের মধ্যে ভাগ হয়। গত বছরও এই সিন্ডিকেট এভাবে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়।
কেন এমন হচ্ছে-এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত এই সিন্ডিকেটই এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর মধ্যে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের গাফিলতিই মূল কারণ। কারণ ২০১৫ ও ২০১৬ সালে যারা হজ করেছেন, তাদের জন্য অতিরিক্ত ফি হিসেবে দুই হাজার রিয়াল (৪৪ হাজার টাকা) দিতে হবে, তা ১০ মাস আগেই সৌদি কর্তৃপক্ষ ধর্ম মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই ফি হজ প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে শেষ মুহূর্তে অনেক হজযাত্রী এ অর্থ পরিশোধে অনীহা দেখানোয় ভিসা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক হজ এজেন্সি এখনো হজযাত্রীদের জন্য সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া সম্পন্ন করেনি। যদিও নির্দেশনা রয়েছে, সৌদি আরবে হাজিরা যে বাড়িতে থাকবেন, সেই বাড়ি বা হোটেলের নাম, তাসরিয়া নম্বরসংবলিত স্টিকার তাদের পাসপোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। হজ এজেন্সিগুলো শেষ সময়ে কম টাকায় বাড়ি ভাড়া সুবিধা নিতে দেরিতে বাড়ি ভাড়া করছেন বলে ভিসা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া সৌদি আরব এ বছর ই-হজ ব্যবস্থাপনা চালু করায় সৌদি আরব ও বাংলাদেশে দেখা দেওয়া কারিগরি সমস্যার কারণেও ভিসা দিতে সমস্যা হচ্ছে।
হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সৌদি আরবে মোয়াল্লেমদের ফি বেড়ে গেছে। বিগত বছরগুলোতে ৭২০ রিয়ালে মধ্যে মোয়াল্লেম ঠিক করলেও এ বছর হজ এজেন্সিগুলোর কাছে সৌদি আরবে মোয়াল্লেমরা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ রিয়াল বাড়তি দাবি করছেন। এ বাড়তি ব্যয়ের বোঝা কমাতে কম টাকায় বাড়ি ভাড়া নেওয়া প্রবণতা বেড়েছে হজ এজেন্সিগুলোর।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যমান ও সিএ) আবুল হাসনাত জিয়াউল হক বলেন, হজযাত্রী পরিবহনে এয়ারলাইনসগুলোর প্রস্তুতি যথাযথ রয়েছে। কিন্তু যাত্রী না থাকায় ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। হজ এজেন্সি, ধর্ম মন্ত্রণালয় ভিসাসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধান করলে ফ্লাইট নিয়ে জটিলতা থাকবে না।
এই অব্যবস্থাপনার খেসারত হিসেবে বিমান কর্তৃপক্ষকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে বলে জানিয়েছেন বিমানের কর্মকর্তারা। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর তাদের হজযাত্রী পরিবহনের কথা ৬৩ হাজার ৬০০ জন। এজন্য তারা ৩টি এয়ারক্রাফট ভাড়া নিয়েছে। কিন্তু রোববার পর্যন্ত তাদের ১৯টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এভাবে চললে আরো ১০টি ফ্লাইট বাতিল হতে পারে। সে হিসেবে শেষ পর্যন্ত কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ হাজার হজযাত্রী সাউদিয়া এয়ারলাইনসকে দিয়ে পরিবহন করাতে হবে। তাহলে বিমানকে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে। কারণ স্লটের অভাবে যদি হজযাত্রী পরিবহন করতে না পারে, তাহলে একদিকে বসিয়ে বসিয়ে লিজ নেওয়া উড়োজাহাজের ভাড়া গুনতে হবে, অপরদিকে হজযাত্রীর পুরো বিমান ভাড়া থেকেও বঞ্চিত হবে। একইভাবে শেষ দিকে যাত্রীপ্রতি বিমান ভাড়া প্রায় ১০ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত আদায়েরও পাঁয়তারা করছে এই চক্র।
লেখক: প্রতীক ইজাজ
No comments:
Post a Comment