বন্যার স্থায়ী বন্দোবস্ত
দেশের বন্যা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে চরম আকার ধারণ করছে। বন্যা যেন আমাদের জীবনের সঙ্গে এক অলিখিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসি মানুষের। এর যেন কোনো শেষ নেই। প্রতিদিনই দেশের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। দেশে ৯০টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০টিতে এবং ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, ঘঘট, ধলশ্বেরী, ধরলা, কংসসহ বিভিন্ন নদ-নদীর ১৩টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মায় অব্যাহত পানি বৃদ্ধি ও উজানের অতিবৃষ্টি শঙ্কার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে দেশের ১১ জেলা বন্যাকবলতি। অবিরাম বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন জেলা নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে সেসব এলাকার লাখ লাখ মানুষ। আরো ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। মানুষের মাঝে রয়েছে পাহাড়ধস ও নদীভাঙন আতঙ্ক। বিশুদ্ধ খাবার ও পানির তীব্র সংকট বিরাজ করছে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয়। ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের পাশাপাশি রয়েছে অপ্রতুল ত্রাণের অভিযোগ। আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষের সঙ্গী হয়ে অবস্থান করছে গবাদিপশু। বন্যা ও ভাঙনের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিভিন্ন জেলায় সাড়ে চার হাজার হেক্টরের অধিক জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে কৃষকদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। বন্যাকবলিত এলাকায় বন্ধ রয়েছে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে সাপ ও বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রাণীর উপদ্রব। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পাশাপাশি পানি বাড়ছে গঙ্গা-পদ্মার অববাহিকায়।
এবার আগাম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে এখন আরো জোরালো। উজানে চীন-তিব্বত হিমালয় পাদদেশ হয়ে ভারত অবধি অতিবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশেও বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়েছে। বর্ষা হতে পারে দীর্ঘায়িত। পানির চাপ কমাতে গজলডোবায় তিস্তাসহ ভারতের উজানভাগে সবকটি নদ-নদীর বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভারত পদ্মার উজানে গঙ্গায় ফারাক্কার বাঁধের স্পিলওয়ে ও গেটগুলো খুলে দিতে পারে। এ অবস্থায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও তিস্তাপাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যাকবলতি থাকাবস্থায়ই একসঙ্গে গঙ্গা-পদ্মায় অব্যাহত পানি বৃদ্ধি এবং উজানে ভারী বর্ষণকে এ মুহূর্তে শঙ্কার বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞ মহল। এতে করে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াল অবনতির আশঙ্কা করছেন তারা।
এদিকে নদ-নদী অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দেশে ৯০টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পায় ৭০টিতে। তবে গত সোমবার ছিল ৫৫টি, রোববার ৫১টি ও শনিবার ৪৯টি পয়েন্টে। বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহ বেড়ে হয়েছে সাতটি স্থানে; যা চলমান বন্যার নাজুক অবনতির সূচক বহন করছে। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ আরো অন্তত এক সপ্তাহজুড়ে আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশসহ দেশটির উত্তর-পূর্ব জোনে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে। মৌসুমি বায়ুর একটি বলয় ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর-প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি আগামী দু-তিন দিনও অব্যাহত থাকতে পারে। আর গঙ্গা-পদ্মার অববাহিকায়ও নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি আগামী দু-তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে। সেইসঙ্গে বেড়ে যাবে উজানের ঢল-বানের তোড়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এ বছর চীন, ভারত ও বাংলাদেশে আগেভাগে ‘বর্ষাকাল’ শুরু হয়। পরপরই শুরু হয় উজানের ঢল ও বন্যার চাপ। মৌসুমি বায়ু সমানতালে সক্রিয় থাকায় বর্ষার ঘনঘটা এখনো জোরালো রয়েছে। আগাম এ বর্ষা যদি চলতি জুলাই মাসের শেষ অবধি এমনকি আগস্ট পর্যন্ত চলতে থাকে, তাহলে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকার পাশাপাশি একযোগে গঙ্গা-পদ্মাসহ এর উপ কিংবা শাখা নদীগুলো ফুলে-ফুঁসে উঠতে পারে। বৃহত্তর সিলেট-ময়মনসিংহ অঞ্চলেও বন্যা আরো বিস্তৃত হতে পারে। এতে করে বন্যা ভয়াল রূপে মোড় নিতে পারে। গত দশ বছরের মধ্যে দেশে ব্যাপক বন্যা হয়নি। ২০০৭ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এবারের বন্যার গতি-প্রকৃতির উপরোক্ত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি মৌসুমি বায়ুর চলমান ঘোর বর্ষার মতিগতি বন্যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। মৌসুমি বায়ু আগাম সক্রিয় হওয়ায় এ বছর বর্ষার আগমনও হয় তাড়াতাড়ি। বৃষ্টিপাতও হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলার জন্য সরকারকে প্রথম থেকেই সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। কোনো এলাকায় বন্যা এসে গেলে তখন তা হ্যান্ডেল করা কঠিন। এজন্য আগেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়াটাই জরুরি। তথ্য-পরিসংখ্যান ও বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহ আরো বেড়ে গেছে। গঙ্গা-পদ্মার ভাটির দিকে বিভিন্ন পয়েন্টে দিন দিন পানি বেড়েই চলেছে। যদিও তা এখনো বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারা নদীসমূহের পানি সামান্য কমলেও তিনটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরেই রয়েছে। পানি হঠাৎ আরো বেড়ে গিয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সর্ব-উত্তর জনপদের কুড়িগ্রামের ধরলা নদী।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রমতে, নয়টি নদ-নদীর ১৩টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে পানি প্রবাহিত হয়েছে। ১১টি জেলা রয়েছে বন্যাকবলতি। ৯০টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে পানি বৃদ্ধি পায় ৭০টিতে। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদ ছিল আগের মতোই ঊর্ধ্বমুখী। তিস্তায় পানি বিপৎসীমার ওপরে কিছুটা কমেছে। মধ্যাঞ্চলে টাঙ্গাইলে ধলেশ্বরীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় নদ-নদীসমূহে পানির অব্যাহত বৃদ্ধির মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। এই অববাহিকায় পদ্মা নদী গোয়ালন্দ, ভাগ্যকুল ও সুরেশ্বরে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গঙ্গা-পদ্মার ভাটির দিকে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদ-নদী, শাখা-উপনদীতে ঘূর্ণি স্রোত, ভাঙনও দেখা দিয়েছে। এতে করে ব্যাহত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে ফেরি ও নৌ-চলাচল। দক্ষিণ-পশ্চিমে যশোরের ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদ এবং খুলনায় পশুর নদীর পানি অবিরাম বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি রয়েছে। আবার ময়মনসিংহের নেত্রকোনায় কংস নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আসামের লুসাই পাহাড়ি এলাকায় প্রবল বর্ষণের কারণে উজানের ঢল নামতে থাকায় দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য
অববাহিকার প্রধান নদী খরস্রোতা কর্ণফুলীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বন্যার তান্ডবে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন ও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে। এতে কোনো কোনো স্থানে ঘরবাড়ি বিলীন হচ্ছে নদীতে। আবার পাহাড়ধসে ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। প্রতিদিন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। বর্ন্যাত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সুতরাং চলমান বন্যা ও আগামীর ভয়াবহতাকে মোকাবিলার জন্য সরকারকে আগাম চিন্তাসহ পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এবং গোটা জাতিকে দাঁড়াতে হবে সরকারের পাশে। তাহলেই আমরা কোনো বন্যার কাছে পরাভূত হব না।
No comments:
Post a Comment