Thursday, March 2, 2017

মানুষের পেটে সোনার ডিম!



ঈশপের গল্পে সোনার ডিমের কথা অনেকেরই জানা। কৃষকের হাঁস প্রতিদিন একটি করে সোনার ডিম পাড়ত। লোভী গৃহস্থ কৃষকের ইচ্ছে হলো হাঁসের পেট কেটে সোনার সব ডিম একসঙ্গে বের করে বিরাট ধনী বনে যাবে। এমনটি ভেবে অকৃতজ্ঞ কৃষক হাঁসটি জবাই করে ফেলল। পরে সে দেখল, হাঁসের পেটে কোনো সোনার ডিম নেই। রূপকথার হাঁস সোনার ডিম পাড়লেও বাস্তবের কোনো হাঁস সোনার ডিম পেড়েছে, এমন তথ্য কারো জানা নেই। তবে সবারই জানা, আমাদের দেশে এমন মানুষ পাওয়া যায়, যাদের পেট থেকে সোনার ডিম বা সোনার বার পাওয়া যায়। এমনই খবর প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় পত্রিকায়।
দেশের দুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালাল ও শাহআমানতে একইদিনে দুই ব্যক্তির পেট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তিন কেজি সোনা। দুবাই থেকে শাহআমানতে আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা উদ্ধার করেন চারটি সোনার বার। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে লোভী গৃহস্থের মতো আরো সোনা পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন তারা। লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদে যাত্রী আনোয়ার স্বীকার করেন তার পেটে ১৫টি সোনার বার রয়েছে। ওষুধ খাইয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা সে ‘সোনার বারগুলো’ (ডিম) বের করতে বাধ্য করেন। একইদিন ওমানের মাস্কাট থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায় আসেন মোসলেম উদ্দিন নামে এক যাত্রী। তার আচরণে সন্দেহ হলে পেট এক্স-রে করে সোনার বারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মোসলেম উদ্দীনকেও ওষুধ খাইয়ে আটটি ‘সোনার ডিম পাড়তে’ বাধ্য করা হয়। লোভী কৃষক হাঁসের পেট কেটে সোনার ডিম সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলেও কাস্টমস গোয়েন্দারা সফল হয়েছেন, এজন্য তারা ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
গত তিন বছরে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের নানা অভিযানে চোরাচালান করা প্রায় ৩ হাজার ৯০০ কেজি বা প্রায় ১০০ মণ সোনা আটক করা হয়েছে। যার মূল্য ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।
এত আটকের পরও বন্ধ হয়নি সোনা চোরাচালান। বরং চোরাই সোনার চালান আসছেই। এ পর্যন্ত যত সোনা আটক হয়েছে, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সোনা পাচার হয়েছে নিরাপদে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ময়লার ঝুড়ি থেকে তিন কেজি ওজনের ১০টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়েছে। ইমিগ্রেশনের পাশের টয়লেটের ভেতরে রাখা ময়লার ঝুড়িতে পরিত্যক্ত অবস্থায় সোনার বারগুলো উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। উদ্ধার হওয়া সোনার বাজারমূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা।
নিত্যনতুন কৌশল ও স্থান পরিবর্তন করে সোনা চোরাচালান হচ্ছে। কখনো শরীরের ব্যান্ডেজে, কখনো পায়ুপথে, হুইল চেয়ারে, জুতা, স্যান্ডেল, বেল্ট, সাবান কেস, ল্যাপটপের ভেতরÑ অদ্ভুত সব কায়দায় সোনা পাচার হচ্ছে। অথচ গত ১০ বছরে বৈধ পথে এক ভরি সোনাও আমদানি হয়নি। এই সময়ে সোনা আমদানির অনুমতি চেয়ে একটি আবেদনও করেনি কেউ।
এদিকে সোনা আটক ও উদ্ধারের সংখ্যার ধারেকাছেও নেই মামলার সংখ্যা। সরকারি পুরস্কারের লোভে একশ্রেণির কাস্টমস কর্মকর্তা মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করেন বলে জানা গেছে। বিভিন্ন সময়ে সোনা পাচারের অর্ধশতাধিক মামলা প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেছে। অগ্রগতি শূন্যের কোঠায়। ফলে বরাবরের মতোই আড়ালে থাকছে চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই দেশের ব"হত্তম সোনা চোরাচালানের ঘটনা ধরা পড়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। কাঠমান্ডু থেকে আসা বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি এয়ারক্রাফট থেকে ১ হাজার ৬৫টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। কেজির হিসাবে এই সোনার ওজন দাঁড়ায় ১২৪ কেজি ২১৬ গ্রাম। এ সোনার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। তবে ওই বছর সবচেয়ে বড় ও দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনার চালান ধরা পড়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফাইটে তল্লাশি চালিয়ে এর টয়লেটের ভেতর থেকে ১০৬ কেজি সোনা উদ্ধার করেন কাস্টমস গোয়েন্দারা। এই সোনার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৪৭ কোটি টাকা। সবশেষ চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমানের দুবাই-চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের একটি উড়োজাহাজ থেকে ৬২ কেজি ৩৭৭ গ্রাম ওজনের সোনার বার উদ্ধার করা হয়। ১-২টি বড় উদাহরণ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই ধরা পড়ছে সোনার চালান। এভাবে সোনা চোরাচালান অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেড়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিন বছরে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের নানা অভিযানে চোরাচালান করা প্রায় ৩ হাজার ৯০০ কেজি বা প্রায় ১০০ মণ সোনা আটক করা হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৮৫০ কোটি। এসব ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে অন্তত দুই শতাধিক ব্যক্তি। তবে এদের অধিকাংশই জামিনে রয়েছে। কাস্টমস হাউসের হিসাব মতে, শাহজালাল বিমানবন্দরে ১২৫টি সোনার চালান আটকের ঘটনায় থানা ও বিভাগীয়সহ ৭০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রহস্যজনক কারণে অর্ধশতাধিক মামলার তদন্ত থেমে গেছে।
আশির দশকে এ দেশে চোরাচালানের মাধ্যমে সোনা আসা শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে চোরাচালানের ৯৬ কেজি ৫২৫ গ্রাম সোনা উদ্ধার করা হয়। ওই বছরই সোনা চোরাচালানের অভিযোগে ২৬টি মামলায় ৩১ জন আটক হয়। ১৯৮৬ সালে উদ্ধার হয় ১২০ কেজি ২২৫ গ্রাম সোনা। ওই বছর সোনা চোরাচালানের অভিযোগে ৩৮ জনের বিরুদ্ধে ৩৮টি মামলা হয়। গত বছর থেকে প্রতিমাসে মণকে মণ চোরাচালানের সোনা আটক হচ্ছে চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে চোরাচালানের স্বর্গদ্বার হিসেবে ব্যবহার করছে সোনা চোরাকারবারিরা। এ ছাড়া দেশের সীমান্তের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব রুট দিয়ে চালান সরাসরি ভারতীয় সোনা ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়। একটি চালান নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পাচারকারী সিন্ডিকেটকে ঘাটে ঘাটে টাকা গুনতে হয়। তবেই কাড়িক্ষত চালান হাতে পায় পাচারকারীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোনা আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করায় ভারতে এর আমদানি ৯৫ শতাংশ কমে যায়। তা ছাড়া সে দেশে সোনা আমদানিতে শুল্ক হার ৬ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এতে সোনা আমদানিতে আরো ধস নামে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সোনা ব্যবহারকারী দেশ ভারতে সোনা পাচার অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। তাই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের চোরাকারবারিদের কাছে সোনা পাচার এখন অধিকতর লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সোনা পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। অতি সম্প্রতি তল্লাশি কিছুটা জোরদার হওয়ায় পাচারের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে সোনা চোরাচালানকারীরা। সোনার বার গিলে ফেলে পেটে করে সোনা পাচারের কৌশলকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। তাদের কপাল মন্দ যে, শুল্ক গোয়েন্দাদের সতর্কতায় তাদের সে কৌশল মাঠেমারা যাচ্ছে। আমরা আশা করব, এ সাফল্যে আত্মপ্রসাদ লাভ না করে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সোনা ও মাদক পাচার রোধে আরো কঠোর হবেন। সোনা ও মাদক চোরাচালানের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত ভাড়া খাটা লোকজন শুধু নয়, নেপথ্যের হোতাদেরও আইনের আওতায় আনতে সচেষ্ট হবেন—এমনটিই প্রত্যাশা।
লেখক: হেলেনা জাহাঙ্গীর; চেয়ারম্যান, জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন

No comments:

Post a Comment