Friday, February 24, 2017

বিশুদ্ধ ভাষাচর্চা জরুরি

মানুষের অনেকগুলো শক্তির মধ্যে একটি হলো ভাষা। বাকশক্তিতে অক্ষমতা থাকলে জীবনে বিজয়ী হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এটা মহান আল্লাহ তায়ালারই অনেক বড় নিয়ামত, দান। জীবনে বিশুদ্ধভাষী হওয়া জরুরি। একজন স্পষ্টভাষী মানুষ সবর্ত্রই আলাদা গুরুত্ব পায়। লড়াই করে আমরা যে ভাষাটা পেয়েছি, একে কেন ভালোভাবে অর্জন করব না। দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। ‘বাংলা’ যখন নিজ দেশেই অবহেলায় থাকে, তখন বাইরের দেশে কিভাবে গুরুত্ব পাবে!
আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলি। আঞ্চলিক, গ্রাম্য বা মা-বাবা থেকে আমরা যে ভাষা শিখি, সেটাই মাতৃভাষা। মাতৃভাষার আলাদা একটা জগৎ আছে। তবে মৌলিকভাবে নিজ দেশের ভাষা সম্পর্কে ধারণা থাকা একান্ত আবশ্যক। বিশ্বের ২১৫ মিলিয়ন বাংলা ভাষাভাষীর মধ্যে ১৫০ মিলিয়নই বাংলাদেশি। গোটা বাংলাদেশের মানুষই এই একটি ভাষাকে চেনে, জানে। আরো অনেকগুলো ভাষায় এখানকার মানুষ কথা বলে। তবে বাংলাকে সবাই আপন করে নিয়েছে। অনেক বিদেশিও বাংলাদেশে এসে বাংলা শিখেছেন। প্রথম বাংলা ব্যাকরণও রচনা করেছেন একজন বিদেশি ভদ্রলোক। ১৮০১ সালে প্রথম ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন উইলিয়াম কেরি। পরে ১৮৩৩ সালে রাজা রামমোহন রায়, ১৯৩৫ সালে এসে মুসলিম কথাশিল্পী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ নামে পুস্তক প্রকাশ করেন। পৃথিবীতে বাংলা ভাষার পরিচিতি ঘটে মূলত ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের পর থেকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলা এবং লেখাপড়া করার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করে এ দেশের তরুণরা। সেই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে।
মাতৃভাষার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর শাহাদাতের পেয়ালা চুম্বনের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বাঙালি জাতির জন্য অনেক বড় একটি বিষয় ছিল এই ঘোষণা। যথাযথ কাজে লেগেছে—এমন কথা বলা যাবে না। এই প্রিয় বাংলা ভাষার জন্য যথেষ্ট ত্যাগ করেছেন আমাদের লাল-সবুজের দামাল সন্তানরা। এখনো বেঁচে আছেন অসংখ্য ভাষাসৈনিক।
দেশের হাজারো রকমের আঞ্চলিক ভাষাকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করলে কোনটি প্রকৃত বাংলা ভাষা, তা নির্ণয়ে বিভ্রান্তিতে পড়বে যে কেউ। তাই বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা করা জরুরি। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেও এই উদ্যোগ বাস্তবসম্মত। কারণ, ইসলামের নবী অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন না, তবে ভাষাজ্ঞানী ছিলেন; বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারতেন। নবীজির কথা শুনলেই মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত তাঁর দিকে। এ এক বিস্ময়কর শক্তি অর্জন করেছিলেন তিনি। দ্বীনের দাওয়াতের শুরুর দিকে মক্কায় নবীজি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখার জন্য একদল লোক তাঁকে পাগল বলে প্রচার করত। পথের মোড়ে, হাট-বাজারে বা মানুষের জটলায়, হজের সময় জোরে জোরে চিৎকার করে মক্কার নেতাদের নির্দেশ মান্য করতে নবীজির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হতো। কিন্তু সেগুলো বরাবরই হিতে বিপরীত হয়েছে। অতিরিক্ত প্রচারের কারণে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষের মধ্যে কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। এই কৌতূহলের কারণেই নবীজিকে একনজর দেখার জন্য আগন্তুকদের মধ্যে আগ্রহ বেড়ে যায়। যারাই নবীজির সামনে হাজির হয়েছে, কথা শুনেছে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো নবীজির আহ্বান মেনে নিয়েছে। তারা অবাক হয়েছে, ‘একজন জাদুকর বা পাগল এত সুন্দর করে কথা বলে কিভাবে?’
তাই আজকের এই দিনে ইসলাম প্রচারের জন্য বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা করতে হবে। মাতৃভাষার বিশুদ্ধভাবে চর্চা করাটা নবীজির সুন্নাতও। পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘দয়াময় রহমান আল্লাহ! কুরআন পাঠ শেখালেন; মানুষ সৃষ্টি করলেন; তাকে ভাষা বয়ান শিক্ষা দিলেন।’ [সূরা আর-রহমান, আয়াত ১-৪]
ভাষা যাতে বিশুদ্ধ হয়, সাবলীল হয়, সেজন্য মহান আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করে দোয়াও শিখিয়েছেন। আমরা হজরত মূসা আলাইহিস সালামের কথা জানি। ছোটবেলায় তিনি আগুনের দলা মুখে পুরে দিয়েছিলেন। এ কারণে পরে তাঁর মুখের ভাষা খুব স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু দ্বীন প্রচারের স্বার্থে একজন বিশুদ্ধভাষী মানুষ দরকার ছিল। হজরত মূসা (আ)-এর ভাই হজরত হারুন (আ) ছিলেন বিশুদ্ধভাষী ও বাগ্মী ব্যক্তিত্ব। আল্লাহর কাছে নিজের ভাইকে নবী হিসেবে ঘোষণা দেয়ার জন্য আবেদন করলেন আল্লাহর কাছে। শুধু স্পষ্টভাষী ও সুবক্তার প্রয়োজনেই মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করলেন। হজরত হারুন (আ)-কে ঘোষণা দিলেন নবী হিসেবে। পৃথিবীতে নিজ ভাইয়ের জন্য এত বড় করুণা করার ইতিহাস আর নেই। কুরআনের ভাষায় হজরত মূসা (আ) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সিনা প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। আমার ভাষার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। আমার জন্য একজন সাহায্যকারী বানিয়ে দিন আমার স্বজনদের মধ্য থেকে; আমার ভাই হারুনকে; তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন এবং তাকে আমার (দাওয়াতি-প্রচার) কাজের শরিক করুন, যাতে আমরা আপনার পবিত্রতা ও মহিমা বেশি বেশি বর্ণনা করতে পারি এবং আপনাকে অধিক স্মরণ করতে পারি। আপনি তো সর্বতো প্রত্যক্ষকারী।’ [সূরা ত্বহা, আয়াত ২৫-৩৬]
দৈনন্দিন জীবনেও নবীজি কথায়, আচরণে বাগ্মী ছিলেন। তার শাসনে-আচরণে-কথায় কারো মন খারাপ হতো না। হজরত আনাস (রা.) তো ১০ বছর নবীজির সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। হজরত আনাস (রা)-এর ভাষ্য, মন খারাপ করতে হয় এমন কথা নবীজি কোনোদিন বলেননি।
আজকের শাসন-শোষণের যুগে যারা কাজের লোক পরিচালনা করেন, তাদের পক্ষে কি সম্ভব এক দিনও রাগ না করে তাকে কিছু বলবেন না? বিশ্ববাসীর জন্য যিনি রহমত হিসেবে এসেছেন, তিনি ভাষার বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রেও রহমতস্বরূপ, আলোকবর্তিকা।
পরিবারই বিশুদ্ধ ভার্ষাচর্চার আসল ঠিকানা, একটি প্রাচীন সংগঠন। শিশুদের চিন্তা বিকশিত করার জন্য পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পরিবারের ছোটরা বড়দের নকল করে। নিজেদের মধ্যে বহন করে বা আত্মকরণ করে। তাই পরিবারের বড়রাও গুরুজন। তাদের অবশ্যই সংযত হয়ে ভাষাচর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
এ দেশের মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানানোর জন্য ১৮৭৫ সালের পর মুন্সী মেহেরুল্লাহ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ানো উচিত। এখনকার মানুষকে আরবি, উর্দু বা ফার্সি নয়, বাংলায় বোঝাতে হবে। দ্বীন প্রচারের জন্য বাংলা ভাষাকে আপন করে নিতে হবে।
ইসলামের ইতিহাসের সূচনাই বিশুদ্ধ ভাষা দিয়ে। জান্নাতেও বিশুদ্ধ ভাষার চর্চা হতো। পৃথিবীতে কালের বিবর্তনে হাজারো ভাষা বেড়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। সাহাবাদের মধ্যেও এই প্রবণতা ছিল। পবিত্র কুরআন নাজিল হয়ে আরবের সর্বোচ্চ আধুনিক ভাষাসাহিত্যকে ম্লান করে দেয়। আরবি সাহিত্যে এর চেয়ে খোরাক আর নেই। নবীজির হাদিসও আরবি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে।
ইমাম বুখারি ‘আল-আদাবুল মুফ্রাদ’-এ ‘অশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারে প্রহার’ অনুচ্ছেদে হজরত নাফে (রা) থেকে বর্ণনা করেন, ইবনে উমর (রা) তার সন্তানকে অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার কারণে প্রহার করতেন। ইবনে তাইমিয়া (র) বলেন, ‘পূর্বসূরিরা ভাষায় ভুল করলে তাদের সন্তানদের শাসন করতেন।’ (মাজ্মূউল ফাতাওয়া, ৩২/২৫২)
ভাষা আসলে তখনো একটা আভিজাত্য বহন করত। সামাজিকভাবে বিশুদ্ধভাষীরা সম্মানিত হিসেবে বিবেচিত হতেন। ইমাম যুহরী (র) বলেন, ‘আমার মতে, বিশুদ্ধ ভাষার চেয়ে বড় আভিজাত্যের বস্তু আর কিছু নেই। বিশুদ্ধ ভাষা আভিজাত্যের অন্তর্ভুক্ত। [হিল্ইয়া ৩/৩৬৪ ও বাহ্জাতুল মাজালিস, ২/১/৬৪৩]
ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভিধায় অভিষিক্ত আল্লামা ইবনুল মুবারক (র) বলেন, ‘ভাষার সংশোধন এবং এর সঠিক ব্যবহার সবচেয়ে বড় আভিজাত্য।’ [আল-মুরুআ, আবু বকর মারযুবান, ৭০]
এখনকার এই সমাজও এর বিরুদ্ধে নয়। এই সময়েও যিনি বিশুদ্ধ উচ্চারণ চর্চা করেন, তারও চাহিদা যেমন আছে, তেমনি সমাজে তার গুরুত্ব অনেক।
আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান তার সন্তানদের অশুদ্ধ ভাষা শুনলে খুব কষ্ট পেতেন। তিনি বলতেন, ‘ভাষার ভুল কাপড়ের ছিদ্র ও মুখে গুটিবসন্তের চেয়েও জঘন্য।’ [আল-আদাবুস সুলতানিয়া, ১/৪৫]
আল্লাহর নবীর কাছে বিশুদ্ধ ভাষার যে অহিমালা নাজিল হতো, সেগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য বেশ কয়েকজন সাহাবি দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁদের মধ্যে হযরত মুয়াবিয়া (রা) অন্যতম। তার কাছে একবার যিয়াদ তাঁর সন্তান উবায়েদকে পাঠালেন। সার্বিক পর্যবেক্ষণের পর মুয়াবিয়া (রা) যিয়াদের কাছে চিঠিতে লিখেন, ‘তোমার ছেলে যেমন বলেছিলে, ঠিক তেমনি, তবে ভাষাটা একটু ঠিক করে দিও।’ [আল-বয়ান ওয়াত-তাবয়ীন, ১/১৪৫]
সাহাবা যুগেও বিশুদ্ধভাষীদের চাহিদা ছিল। তখনো বিশুদ্ধ চর্চা ছিল। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার একটি শিরোনাম, ‘মান কানা ইউয়াল্লিমুহুম ওয়াদ্রিবুহুম আলাল লাহ্নি’ অর্থাৎ ‘সন্তানকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া এবং ভুল হলে শাসন করা প্রসঙ্গে’। আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত আছে, ‘কথাবার্তায় ভাষাগত ভুল হলে তিনি সন্তানদের শাসন করতেন।’ কারণ, সংসারও একটা ক্লাসের মতো। শিশুরা মায়ের স্কুলেই বড় হয়। নৈতিক ও আদর্শ মানুষ হওয়ার সবক তো ওখান থেকে পেতে শুরু করে শিশু।
তাই পারিবারিকভাবেই ভাষার বিশুদ্ধতার চর্চা হওয়া উচিত। অনেক সময় ঘরে বিশুদ্ধ ভাষার চর্চা হলেও স্কুলে হয় না। তাই বিভিন্ন শিশুর সঙ্গে মিশে নানা রকম ভাষা শিখে ফেলে শিশুরা। আদরের সোনামণিদেরও স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত।
লেখক:মাসউদুল কাদির; ইকরা বাংলাদেশ হবিগঞ্জের প্রিন্সিপাল, কলামিস্ট।

No comments:

Post a Comment