Friday, February 10, 2017

অদ্ভুত উটের পিঠে যুক্তরাষ্ট্র

ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসলাম এবং মুসলিমবিদ্বেষী—এটা নতুন কথা নয়। যেটা নতুন, তা হচ্ছে, তিনি আমেরিকার মিডিয়াবিদ্বেষীও।তিনি সাংবাদিকদের ‘করাপ্ট পিপলস’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। কেন সাংবাদিকরা অসৎ, তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। কিভাবে তারা অসততা করছে, কিভাবে তারা সেই অসততার বলে একটা কিছু করছে, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন অন্য প্রসঙ্গের জেরে। বলেছেন, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। প্রায় তিন মিলিয়ন ‘চোরা ভোট’ পড়েছে হিলারির পক্ষে। এই অভিযোগ তোলার পেছনে আছে ডেমোক্র্যাটরা তার বিজয়ে রুশ হ্যাকিংয়ের অভিযোগ আনায় এবং মিডিয়া তা ফলাও করে প্রচার ও প্রকাশ করায়। নির্বাচনী মেশিনারি হ্যাক করে ফলাফল পাল্টে দিয়েছে রুশ হ্যাকাররা। বিশেষ করে ফ্লোরিডার ফলাফল পাল্টে দিয়ে ট্রাম্পকে জেতানো হয়েছে।সেখানে হিলারি অগ্রগামী ছিলেন প্রায় শেষাবধি। পেনসিলভানিয়ার ফলও তারা পাল্টে দিয়েছে। এভাবেই হেরে যাওয়া প্রার্থীকে ইলেক্টোরাল কলেজের সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছে তারা।
সেই ‘কু-ইমেজ’ পাল্টাতেই ট্রাম্প উল্টো অভিযোগ করছেন, মিডিয়া করাপ্ট। যেহেতু সাংবাদিকদের প্রতিদিনকার রিপোর্টে, জনমত যাচাই ভোটে, দেশব্যাপী ট্রাম্পের বর্ণবাদী হুংকার, মুসলিমবিরোধিতার বিরুদ্ধে মিডিয়ার সৎ ও ত্বরিত তৎপরতা, তিনটি ডিবেটে হিলারির কাছে ধরাশায়ী হওয়া, মিডিয়ার জনমত যাচাইয়ে হেরে যাওয়া ট্রাম্পের ইমেজ তুলে ধরা, তার ১৮ বছর ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া, ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ২৫ মিলিয়ন ডলার মেরে দেয়া, জুয়াড়ি ব্যবসায়ী হিসেবে তার কুকীর্তি তুলে ধরা এবং হিলারি বিজয়ের পথ নিউজ দিয়ে সুনিশ্চিত করার ‘অপরাধে’ মিডিয়াকে করাপ্ট হিসেবে চিত্রিত করেছেন ট্রাম্প। সর্বশেষ বিতর্কে তিনি হুমকি দেন এই বলে যে, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে হিলারিকে জেলে নিয়ে যাবেন। সব মিলিয়েই তিনি মিডিয়ার ওপর ক্ষ্যাপা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন মিডিয়া এই অপবাদ মাথায় নিয়ে ট্রাম্পের শাসনাধীনে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে।
সাংবাদিকরা নিরলসভাবে কাজ করেন। পালন করেন সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব। ‘সমাজের শিক্ষক’ তারা। কোনো দুর্নাম ও হুমকির ভয়ে ভীত নন। তারা সূক্ষ্মভাবে কাজ সম্পাদন করেন। প্রেসিডেন্সিতে বসেই ট্রাম্প এমনসব কাজ শুরু করেছেন যে, গোটা দেশই কেবল নয়, বিশ্বনেতারাও চমকে যাচ্ছেন। ৭টি প্রি-ডমিন্যান্টলি মুসলিম দেশের অভিবাসীই কেবল নয়, সেসব দেশের বৈধভাবে ভিসা পাওয়া লোকেরাও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবে না বলে নির্বাহী আদেশ দিয়েছেন। আজও সেই আদেশের খেসারত টানতে হচ্ছে ট্রাম্পকে। জেএফকেতে আটকে দেয়া ভ্রমণভিসাধারী ও গ্রিনকার্ডধারীদের ডিটেনশনে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে মামলা হলে ব্রুকলিনের একজন ফেডারেল বিচারক ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত করেন এবং আটকদের দেশে ঢুকতে দেওয়ার নির্দেশ দেন। দেশব্যাপী নারীবাদীদের প্রতিবাদ এবং তাদের ‘জেগে থাকা’র স্লোগান থেকেও প্রশাসন টের পেয়েছে, কত ধানে কত চাল। আর এসব প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সব খবর খুব যোগ্যতার সঙ্গে মিডিয়া তুলে ধরছে। জানাচ্ছে দেশবাসীকে, জানাচ্ছে বিশ্ববাসীকে। এতে ট্রাম্পের ইমেজ আরো খারাপ হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, একজন জুয়াড়ি বা ক্যাসিনো ব্যবসায়ী মননগতভাবে, মানসিকভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবেও যে ‘অসৎ’, সেটা আর নতুন করে প্রমাণের দরকার নেই। সেই অসৎ মানুষটি যখন সততার কথা বলে, তখন ‘ভূতের মুখে রাম নাম’-এর মতোই লাগে। সাংবাদিকরা যদি করাপ্ট হয়, তাহলে জুয়ার বিজনেসটা কি সততার প্রতীক? দুনিয়ার সবকিছুই তো পাল্টে যাচ্ছে। সেই বিচারে মার্কিনি রাজনৈতিক ক্লাইমেট চেইঞ্জ হয়ে গেছে বোঝা যায়। আমেরিকার ‘রাজনৈতিক ওজোন স্তরে’ বিশাল হোল বা গর্ত হয়েছে বলেই একজন জুয়াড়িকে রিপাবলিকানরা মনোনয়ন দিয়েছিল। হয়তো তারা ভেবেছিল, প্রাইমারিতেই হেরে যাবে ট্রাম্প। সেটা ট্রাম্প বুঝতে পেরেই পুতিনের রাজনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে হ্যাকিং করে জিতেছেন। সেই কাজটি ফাইনাল রাউন্ডেও সেরেছেন ট্রাম্প।
নির্বাচনে জেতা সহজ নয়—এটা জানা আছে রিপাবলিকানদের। কিন্তু ট্রাম্প যখন জিতে গেলেন ইলেক্টোরালে, তখন সেই বিজয়কে বিজয় বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। যেসব কট্টরপন্থি লোককে নিয়োগ দিয়ে চলেছেন ট্রাম্প তার প্রশাসনের বিভিন্ন পজিশনে, এতে, দেশের যে মৌলিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন শত শত বছর ধরে অর্জিত হয়েছে, সেই বহু বর্ণ, বহু ধর্ম আর বহু সংস্কৃতির সম্মিলিত রাষ্ট্রনৈতিক চেতনাসৌধ আজ ভেঙে পড়ার উপক্রম।
৭ ফেব্রুয়ারির নিউইয়র্ক টাইমসের একটি নিউজে পড়লাম, ফেডারেল বিচার বিভাগের প্রশাসন সবিনয়ে অনুরোধ করেছে ফেডারেল বিচারকদের প্রতি, তারা যেন প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশের মূল লক্ষ্য স্মরণে রেখে মামলাটির রায় দ্রুত দেন। অর্থাৎ, তারা চাইছেন ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের কার্যকারিতা। ট্রাম্প প্রশাসন সেটা চাইবেই। এটা মনে রাখতে হবে, বিচার বিভাগীয় প্রশাসন আর বিচারপতিরা এক ঘরের বসতি হলেও তারা বিচারক হিসেবে সংবিধানের ব্যাখ্যাতা। বিচারকরা বলেছেন, ট্রাম্পের এই নির্বাহী আদেশ সংবিধানসম্মত নয়, বরং তা সংবিধানকে অনেকটাই খর্ব করেছে। একে সাংঘর্ষিকও বলা চলে। এজন্যই তারা পূর্ণাঙ্গ শুনানির ভেতর দিয়ে মামলটির নিষ্পত্তি করতে চান। সংবিধানকে লঙ্ঘন করলে এই আদেশ বাতিল হতে পারে। আর সাংঘর্ষিক হলে আংশিকভাবে ছাড় হতে পারে।
সবকিছুই মিডিয়া তুলে ধরছে। আর কেন তারা এ নিয়ে এতটা উৎসাহিত, সেই রাগই প্রকাশ পেয়েছে ট্রাম্পের কথা থেকে। আমেরিকার মিডিয়া যদি অসৎ বা করাপ্ট হয় তার দেশের জন্য, তাহলে পৃথিবীর কোন দেশের মিডিয়া তার দেশের সরকারের জন্য সৎ ও নিষ্ঠাবান? আমরা কি তার কোনো উত্তর দিতে পারব? আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্প চান, তার সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক। সেটা যেমন সরকারি ক্ষেত্রে, তেমনি বেসরকারি ক্ষেত্রে। কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা অনেকটাই সহজ হলেও বেসরকারি ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত দুরূহ। তার মনোনীত শিক্ষামন্ত্রী সিনেট থেকে পাস হতে পারতেন না, যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স তার ভোটটি না দিতেন। সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়বিরোধী বেটসি দ্য ভোস চান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা। ট্রাম্প মিডিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন এজন্যই যে, তারা তার সব অপরাধ-অপকর্ম তুলে ধরে জনগণের সামনে। ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ২৫ মিলিয়ন ডলার মেরে দিয়েছে ইতোমধ্যে। তার শিক্ষামন্ত্রীও চান এরকমটাই। গত ৭ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস শিক্ষামন্ত্রী বেটসি দ্য ভোসের সিনেটে পাস হয়ে আসা এবং বেটসির অতীত কর্মকা- সম্পর্কে যে কড়া সম্পাদকীয়টি লিখেছে, তাতে ট্রাম্প প্রশাসন যে চটবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সম্পাদকীয়টির শেষ বাক্যে এনওয়াইটাইমস বেটসির নিয়োগকে ‘শেইমফুল অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আর তা থেকেই বোঝা যায়, এরা কারা। মাইক পেন্স যে কী রকম শীতল-চেতন মানবতাবিরোধী এবং ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী, তা আগামী দিনগুলোতে আরো দেখার সুযোগ আমেরিকানদের হবে। ঠিক এ কারণেই আমেরিকার মিডিয়াকে ট্রাম্প করাপ্ট বলেছেন। মনুষ্যতর জীবের মধ্যে ট্রাম্প হীনতর বলে যে বিবেচিত, তার আরো নমুনা দেয়া যেতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যেদিন ৭ মুসলিম প্রি-ডমিন্যান্ট দেশের অভিবাসী নিষিদ্ধ করলেন, ঠিক তার পরদিনই টেক্সাসের একটি মসজিদ আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর কানাডার কুইবেক প্রদেশের একটি মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গুলি চালিয়ে অনেককে হত্যা করেছে এক নরাধম। বোঝা যাচ্ছে, ট্রাম্পের অনুসারীর জন্ম হয়েছে কানাডায়।
এই দুটি ঘটনায় ট্রাম্পের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ব্যথিত হয়েছেন তার সাদা চামড়ার এমন মানবতাবিরোধী কাজে। তিনি পরবর্তী শুক্রবার মসজিদে উপস্থিত হয়েছেন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। আর টেলিভিশনে দেখেছি, শোক প্রকাশের অনুষ্ঠানে তাকে কাঁদতে। দুজনের মধ্যে মানবিক চেতনার ফারাক কতটা, তা জানা হলো আমাদের। এবং আমরা বুঝতে পারছি, পৃথিবীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে মানবতার ধসেরই যেন সূচনা হলো। মুসলিম নামের দেশ কুয়েত ট্রাম্পের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ৭টি দেশের অভিবাসী ও ভ্রমণকারীদের নিষিদ্ধ করাকে সাপোর্ট করেছে। একই সঙ্গে তারা ট্রাম্পের এই নীতির প্রতিও সমর্থন দিয়েছে—অভিবাসীপ্রত্যাশী ওই ৭টি দেশের যেসব খ্রিস্টান মানুষ বর্ডারে উপস্থিত হবে, তাদেরকে সাদরে গ্রহণের নির্দেশের। তার মানে, কুয়েত কোনো মুসলিম দেশ নয় বা তারা মানবতাবোধটিকে হারিয়ে ফেলেছে। তারা যে ইসরাইলের মতোই একটি মুসলিমবিরোধী শিখন্ডি দেশ, আজ তা পরিষ্কার। ওই দেশের ক্ষমতাসীনরা যে জনগণের অধিকারকে খর্ব করে অন্যায়কে বরণ করছে, তা-ই প্রকাশ পেয়েছে। ক্ষমতায়নের এমন ঘৃণ্য প্রকাশ গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেহারাকে নস্যাৎ করে দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: ড. মাহবুব হাসানআমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও চিন্তক, কবি

No comments:

Post a Comment