দেশ গড়তে মানুষ গড়তে
জনৈক শিক্ষক শিশুশিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলেন, বল তো মাছ কোথায় থাকে। শিক্ষার্থী যথার্থই জবাব দিল, মাছ থাকে ফ্রিজে! এ শিশুটির জ্ঞান সমীকরণ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, আমরা প্রজন্মকে প্রকৃতি থেকে কত দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছি। আজকালকার শহুরে শিশু-কিশোর বা তরুণরাও অনেকে মাছ, ফল, ফুল ও গাছপালার নাম জানে না। তারা সাঁতার জানে না, গাছে কিভাবে চড়তে হয় তাও জানে না। প্রতিদিন যে ভাত খায়, সেই ভাতের চালের বা ধানের নাম জানে না। ধান বা ফসল উৎপাদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। এজন্য ঠিক তারা দায়ী নয়। বংশ পরম্পরায় আমরাই তাদের গ্রামের নাড়ির বাঁধন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছি। আমরা গ্রাম থেকে এসে বড্ড বেশি শহুরে আধুনিক হয়ে গেছি। যান্ত্রিক জীবনের যাতনায় পড়ে আমরা যেন ভুলতে বসেছি শিকড়ের কথা।এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গ্রামের সঙ্গে আমাদের মানবীয় সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে। এখন সময় এসেছে শিকড়ের সন্ধানে ঘুরে দাঁড়াবার। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই আমাদের গ্রামমুখী হতে হবে।
আমাদের মোট জনসংখ্যার ৭২ ভাগ এখনো গ্রামে বসবাস করে। সেখানে যে বিপুল তরুণ সমাজ রয়েছে তাদের ঠিকমতো কাজে লাগানোর ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তবে গ্রাম এখন আর আগেকার সেই গ্রাম নেই। দ্রুত রেমিট্যান্স প্রেরণের সুযোগ, ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যাংকিং সম্প্রসারিত হওয়ায় গ্রামীণ জনগণের মাঝে ব্যাপক অর্থনৈতিক তৎপরতা বেডেছে এবং বাড়ছে। বাংলাদেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু শহরে নয় গ্রামেও দৃশ্যমান। দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ, এর মধ্যে গ্রামীণ অর্থনীতির অবদান অনস্বীকার্য। গ্রামাঞ্চলে কৃষি, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের বেগবান ধারা আশাব্যঞ্জক। কৃষি ক্ষেত্রে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে গ্রামীণ সড়ক-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, গ্রোথ সেন্টার-হাটবাজার উন্নয়ন, সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ ও পুনর্বাসন, বৃক্ষরোপণ, স্লুইস গেট, রাবার ড্যাম ইত্যাদি নির্মাণ, উপজেলা কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ, খাল খনন ও সংস্কার প্রভৃতি কর্মসূচির কারণে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রভাব পড়ছে। এখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে চারপাশের পরিবর্তন দেখলেও অবাক হতে হবে। রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রযুক্তি প্রভাবে গ্রাম শহরের সেই দূরত্ব এখন আর নেই। গ্রামে অভাব ও অভাবী মানুষের সংখ্যা কমে এসেছে। বিদ্যুতের আলোর ঝলক কিংবা সৌরবিদ্যুতের আলোয় আলোকিত গ্রামবাংলার ঘরবাড়ি, রাস্তার দোকানপাট। ঘরে ঘরে টেলিভিশন, ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিল, সোফাসেটসহ শহুরে আধুনিক শৌখিনতার সব কিছুই এখন কমবেশি গ্রামেও আছে। মোটকথা, এখন আর কেউ বলতে পারবে না, দেশ অনেক পিছিয়ে আছে।
গ্রামেই উৎপাদন হয় সব ধরনের ফসল ও ফল। গ্রাম থেকে গেলে শহরের লোকজন তা ভোগ করার সুযোগ পায়। গ্রামের শিশুরা যেভাবে হেসেখেলে, কাদামাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে বড় হয়, শহরের শিশুদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। কারণ, শহর থাকে পিচঢালা। বেশ কয়েক বছর আগে একটি মেডিক্যাল গবেষণার ফল পড়েছিলাম এ রকম—যেসব শিশুকে মাটির সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা হয়, তাদের চেয়ে, যেসব শিশু মাটিতে খেলাধুলা করে বড় হয়, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি। গ্রামের শিশুরা ধুলাবালি-কাদাপানি গায়ে মেখে বড় হয় বলে তাদের শরীর রোগজীবাণুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ধীরে ধীরে রোগ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। সাধারণ সর্দি-জ্বর-পেটের পীড়াকে আমলেই নেয় না তারা। ধুলা-মাটি-বালি এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক টিকা হিসেবে কাজ করে।
সময়ের বাস্তবতায় অভিভাবককে নতুন করে ভাবতে হবে। শিশুকে সময় পেলেই নিয়ে যেতে হবে ফুল-পাখি-গাছের সান্নিধ্যে, পরিচয় করিয়ে দিতে হবে মানুষের জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে। শহুরে শিশুকে বন্দিদশা তথা কৃত্রিম জগৎ থেকে নিষ্কৃতি দিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য। পর্যাপ্ত খেলার মাঠ আর সবুজের সংস্থান তো রাষ্ট্রই করতে পারে। মুক্তভাবে বাঁচার জন্য, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত উন্মুক্ত উদ্যান গড়ে তুলতে হবে, গড়ে তুলতে হবে দূষণমুক্ত পরিকল্পিত শহর ও মহানগর। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কাছে টেকসই উন্নয়নের ধারণা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার, উন্নত নগর পরিকল্পনা এবং বৃক্ষশোভিত সবুজ নগরের বিকল্প নেই। আমাদের দেশে গ্রামের যেসব লোককে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির সুবাদে শহরে থাকতে হয়, তাদের উচিত হবে সময় সুযোগ পেলে ছেলেমেয়েদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছুটা সময় হলেও রাখা। যাতে করে তারা অনুভব করতে পারে গ্রামের আবহাওয়া ও মনোরম পরিবেশ। চিনতে পারে ও পরিচিত হতে পারে গ্রামের বিভিন্ন রকম জিনিসের সঙ্গে। প্রাণখুলে গ্রামের পুকুরে সাঁতার কাটতে পারে। শহরে আজও এমন মানুষ রয়েছে যারা গ্রাম ও গ্রামের পরিবেশ কী তা চেনে না। মাঝে মাঝে আমরা সংবাদমাধ্যমে খবর পড়ি, কোনো ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী, কোনো জায়গায় বা নদীতে গোসল করতে নেমে পানিতে তলিয়ে গেছে। এর কারণ হলো তারা সাঁতার জানেন না। তারা কোনো দিন গ্রামে আসে না। যদিও তাদের পূর্বপুরুষরা গ্রামে ছিল। শহরে আজও এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা গ্রামকে ও গ্রামের মানুষকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। তাদের মন থেকে এই ভাব দূর করে গ্রামে আসার অভ্যাস গড়তে হবে।
গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা নিতে এবং জীবনযাত্রার পার্থক্য অনুধাবনের জন্য চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চংকিং শহর কর্তৃপক্ষ শহরের শিক্ষার্থীদের গ্রামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের মতে, এর ফলে প্রজন্মগত ও ভৌগোলিক দূরত্ব কমানো সম্ভব হবে। তরুণ বয়সেই তারা ব্যয়বহুল-অভিজাত জীবনযাপনের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনসংগ্রাম এবং তাদের বাবা-মা, স্বজন-সহোদর ও পূর্বপুরুষদের জীবনযুদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে। চংকিং পৌর প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গ্রামে অবস্থানের সময় চংকিং অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৭ লাখ শিক্ষার্থীর প্রত্যেককেই ১০০টি করে গাছের চারা রোপণ করতে হয়, এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়, কারখানায় কাজ করতে হয়। চীনে এই প্রক্রিয়ায় স্নাতক পড়া প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থীকে গ্রাম কর্মকর্তা হিসেবে ভাড়া করা হয়েছে। ফলে তারা ধারণা করছে, এসব শিক্ষার্থীর জীবনবোধ হবে মানবীয়। তারা জীবনের কঠিন সংগ্রামকে শক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে পরিশ্রম করে জয় করতে সমর্থ হবে। বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চীনের মতো একটি উদ্যোগ গৃহীত হলে কৃষিক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আসবে। জীবনবোধ, পারিবারিক সম্পর্ক ও দেশীয় সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম।
এখন অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ। তথ্যই বদলে দিতে পারে গ্রামীণ চেহারা, গতি-প্রকৃতি, সূচনা করতে পারে আর্থিক সমৃদ্ধির নবদিগন্ত। চীনের কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে প্রকাশ, এ মুহূর্তে চীনের ৯৯ ভাগ শহরে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। অপরদিকে তাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধাসহ তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের ফলে কৃষক অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রিতে ছয় গুণ বেশি লাভ করতে পারছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ সুযোগটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে। এর ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্যের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়েও সমৃদ্ধ ও সচেতন হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটলে তরুণরাও হয়ে উঠবে কর্মোদ্দীপক। চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে মেধা, শ্রম, পুঁজি ও সময় খাটিয়ে যতটুকু লাভবান হবে, তার চেয়ে বহু গুণে দেশের মাটিতে কম টাকা বিনিয়োগ করে গ্রামীণ এলাকা থেকেও বিপুল আয় করা সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিপুলসংখ্যক যুবক থাকা উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটা বিরাট সুযোগ। বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি যুবকের সংখ্যা ৮ কোটি ৮ লাখ ৪৩ হাজার। এর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার যুবক কমবেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। নিরেট বেকার যুবকের সংখ্যা ৩ কোটি ২৮ লাখ ২৩ হাজার। যুব সমাজের অধিকাংশের অবস্থান গ্রামাঞ্চলে। তাদের মেধা ও শ্রমকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলেই খুলে যাবে উন্নয়নের দুয়ার। ফসল আবাদের পাশাপাশি এখন হাঁস, মুরগি, গরু মোটাতাজাকরণ, মৎস্য, দুগ্ধ খামারের প্রতি তাদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাদের সামনে এসব ক্ষেত্রের সাফল্য সম্ভাবনাগুলোর তথ্য তুলে ধরতে হবে। তাহলে তরুণরা চাকরিনির্ভর না হয়ে আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তরুণদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগাতে হবে।
কোনো দেশের যদি সত্যিকার অর্থে উন্নয়ন করতে হয়, তাহলে অবশ্যই গ্রামীণ পর্যায়ের উন্নয়ন সবার আগে দরকার। আমাদের দেশের গ্রামগুলো শহরের তুলনায় সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নের জন্য গ্রাম পর্যায়ের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের খুবই প্রয়োজন। গ্রামের মানুষকে উপেক্ষা করে প্রকৃত উন্নয়ন অসম্ভব। গ্রামের প্রতি ক্রমাগত উপেক্ষার কারণেই কৃষকদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়েছে। কৃষক যথাসময়ে পান না ভর্তুকি, সার, কীটনাশক, তেল, উন্নত বীজ, সেচ সুবিধা, ফসল ঘরে তোলার গ্যারান্টি ও ন্যায্যমূল্য। বছরকে বছর হাওরের ফসল পানির নিচে তলিয়ে যায়। কৃষক ও দেশের খাদ্যের বিরাট হুমকি জেনেও যথাসময় এবং স্থায়ী পরিকল্পনায় বাঁধ নির্মাণ হয় না। এসব সমস্যার সমাধানে দ্রুত, স্থায়ী ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গ্রাম্য এলাকায় অন্তত উপজেলা পর্যায়ে শিল্পকারখানা-পোশাককারখানা-কুটিরশিল্প স্থাপনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে জায়গা, ব্যাংক লোন, পরামর্শ ও প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়লেই ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এলাকায় কাজ পেলে মানুষ আর শহরমুখী হবে না। শহরে মানুষের অযাচিত চাপ কমবে।
লেখক : এস এম মুকুল; প্রাবন্ধিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
No comments:
Post a Comment