এক কিলোমিটারের বাসভাড়া ২৫ টাকা সিটিংয়ের নামে প্রতারণা
রাজধানীর গণপরিবহনে ভাড়া-নৈরাজ্য
রাজধানীর মিরপুরের কালশী সড়কের মাটিকাটা অংশে ইসিবি চত্বর থেকে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের এমাথা-ওমাথার দূরত্ব মাত্র ১ কিলোমিটার। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই পথটুকুর সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়ার কথা পাঁচ টাকা। অথচ গণপরিবহনগুলো এর ভাড়া আদায় করছে ২৫ টাকা। কোনো যাত্রী এতে আপত্তি করলেই তাকে বলা হয়—‘এটি সিটিং গাড়ি’। ভাড়া নিয়ে এমন অত্যাচার শুধু এখানেই নয়, চলছে রাজধানী জুড়েই। এসব ছাড়াও গণপরিবহন নিয়ে আছে আরো নানা সমস্যা ও অভিযোগ।
রাজধানীতে জনসংখ্যা বাড়লেও কমছে গণপরিবহন। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন গণপরিবহনের চালকরা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, সিটিংয়ের নামে প্রতারণা, কম দূরত্বে যাত্রী না ওঠানো ও সরকারি গণপরিবহন বিআরটিসির অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জনবহুল নগরীর গণপরিবহনগুলো। এসব পরিবহনের চালকদের কাছে অনেকটাই জিম্মি সাধারণ যাত্রীরা। গণপরিবহনের এমন ভয়াবহ নৈরাজ্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী।
রাজধানীর আয়তন ১১৬ দশমিক ৮ বর্গমাইল। এই ছোট্ট জায়গায় বসবাস করছে প্রায় দুই কোটি মানুষ। রাজধানীতে যাতায়াতের জন্য রুট রয়েছে মাত্র ১২২টি। এ রুটগুলোয় চলাচল করছে প্রায় পাঁচ হাজার গণপরিবহন। জনসংখ্যার তুলনায় রুট ও গণপরিবহন কম থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে লাখো মানুষ। সাধারণ মানুষের এসব ভোগান্তির সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন গণপরিবহন কোম্পানি। রাজধানীর রাজপথে গণপরিবহনের ভাড়া আদায়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাসে যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিত-া হচ্ছে চালক-কন্ডাক্টরদের। কোনো কোনো বাসে হয় মারামারিও। কারণ নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ টাকা বেশি দাবি। ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা করে যাত্রীদের মাঝপথে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে বহু। এ ছাড়া গণপরিবহনগুলো দিন দিন সিটিং সার্ভিসে রূপান্তরিত হচ্ছে। সিটিং মানে সিটভর্তি যাত্রী। অতিরিক্ত বা দাঁড়িয়ে যাত্রী যাবে না। কিন্তু এ নিয়ম তারা মানছে না। সিটভর্তি যাত্রী থাকলেও দাঁড় করিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী নিচ্ছে তারা। আর কম দূরত্বের কোনো যাত্রী গাড়িতে ওঠান না চালকরা। লোকাল বা সিটিং বাস কোনোটাতে ঠাঁই পান না কম দূরত্বের যাত্রীরা। ১৫ টাকার দূরত্বে যাওয়া যাত্রীকেও না। অন্যদিকে, সরকারি গণপরিবহন বিআরটিসিও ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছে নৈরাজ্য। অন্যান্য প্রাইভেট কোম্পানির চেয়ে ভাড়া কম হওয়ার কথা থাকলেও যাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। বেসরকারির পাশাপাশি সরকারি গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে এমন নৈরাজ্যে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী।
কাকরাইলে কথা হয় রাজিব সিদ্দিকী নামে এক যাত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি যাব নাবিস্কোতে। আজমেরি গ্লোরি নামক লোকাল বাসে উঠতে চেয়েছি। ওঠার সময় হেলপার বলেন কোথায় যাবেন, আমি বললাম নাবিস্কো। তখনই বলে, না যাওয়া যাবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এক ঘণ্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছি এখানে। বাস আসছে, উঠতে চাইলে উঠতে দিচ্ছে না। আর কিছু বাস আছে গেটলক করে চলে যাচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া ও যাত্রী হয়রানির ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। তবে এর জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত আছেন। তারা এগুলো দেখাশোনা করেন। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশ রয়েছে, তাদের কাছে অভিযোগ জানালে তারা ব্যবস্থা নেবে।
সিটিং সার্ভিস সম্পর্কে তিনি বলেন, সিটিং সার্ভিসের কোনো নিয়ম নেই। প্রত্যেক বাসের জন্য সিট সংখ্যা অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজধানীর বিভিন্ন রুটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাসে ওঠার আগে ও পরে যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় : এখন মিরপুর থেকে কালশী নতুন ফ্লাইওভার হয়ে মহাখালী যেতে সুবিধা হলেও গলাকাটা ভাড়া আদায় করছে পরিবহন কোম্পানিগুলো। গাবতলী থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্কর হয়ে মহাখালী যেতে ভাড়া ২৫ টাকা। অথচ পথিমধ্যে শুধু জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার (দূরত্ব ১ কিলোমিটার) পার হতেই একজন যাত্রীকে ২৫ টাকা গুনতে হয়। সরকারি হার অনুযায়ী এই দূরত্বের ভাড়া কোনোভাবেই ১৫ টাকার বেশি হবে না। কাকরাইল থেকে মগবাজার পেরিয়ে নাবিস্কো নামলে ভাড়া দিতে হচ্ছে ২০ টাকা। মগবাজার থেকে গুলিস্তান দূরত্ব হচ্ছে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। সরকারি তালিকা অনুযায়ী ভাড়া ৭ টাকা। অথচ পরিবহনের চালকরা বাসভাড়া নিচ্ছেন ২০ টাকা। ভাড়া দেওয়ার সময় দু-এক টাকা কম দিলে যাত্রীদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন পরিবহনকর্মীরা। মাঝেমধ্যে হাতাহাতিও হয়। শুধু এসব রুটে নয়। রাজধানী জুড়ে পরিবহন কোম্পানিগুলোর ভাড়া নিয়ে এমন ডাকাতি হরহামেশাই ঘটছে। ফাল্গুন, বিহঙ্গ, বলাকাসহ প্রায় সব কোম্পানির গাড়ির সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। কোনো কোনো বাসে ২০ টাকার নিচে টিকিটই নেই। অথচ পিক-আওয়ারে এসব বাসে দাঁড়িয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় থাকে না। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় এসব বাসের কাউন্টারে শত শত লোক টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে থাকেন বাসের অপেক্ষায়। বাসের সংখ্যা কম থাকায় গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়ার পরও অনেক যাত্রী টিকিট কেটে পরবর্তী বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর ৭০ ভাগ গণপরিবহন সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করছে ১০ টাকা। ২০ ভাগ গাড়ি আদায় করছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। অর্থাৎ ১০ ভাগ গাড়ি নিয়ম অনুযায়ী ৫ বা ৭ টাকা সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করছে।
২০১৫ সালে কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাসের (সিএনজি) দাম বাড়ায় গ্যাসে চালিত বাস-মিনিবাসের ভাড়া প্রত্যেক যাত্রীর জন্য প্রতি কিলোমিটারে ১০ পয়সা বৃদ্ধি করে সরকার। এরপর ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে পুনর্নির্ধারিত ভাড়ার হার কার্যকর হয়েছে। নতুন হার অনুসারে বড় বাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা, মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৬০ পয়সা। এই নিয়মনীতি কোনো পরিবহন কোম্পানি মানছে না।
সিটিংয়ের নামে প্রতারণা : গেটলক, কম স্টপিজ, সিটিং সার্ভিস, হাফ পাস নেই লিখে যে যার ইচ্ছামতো বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। লেখার সঙ্গে কোনো মিল নেই সার্ভিসের। এর নিয়ন্ত্রণ নেই কারো হাতে, নেই জবাবদিহিতাও। সব মিলিয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের কাছে অসহায় যাত্রীরা। ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসের মালিকরা এসব নাম দিয়ে সরকার-নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। মানা হচ্ছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়ার নিয়ম।
মোটরযান আইনে সিটিং সার্ভিস, লোকাল সিটিং, গেটলক—এ ধরনের কোনো বাসসেবার কথা উল্লেখ করা নেই। এসব নাম নিয়ে চলাচল করা মিনিবাসগুলোর বেশির ভাগই যত্রতত্র রাস্তার মধ্যেই যাত্রী ওঠা-নামা করে। তার পরও এসব মিনিবাসের মালিকরা সিটিং সার্ভিস নাম দিয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন। কোনো কোনো মিনিবাসে গন্তব্যভেদে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। মিরপুর-গুলিস্তান, গাবতলী-যাত্রাবাড়ী, মিরপুর-আজিমপুর, মোহাম্মদপুর-শনির আখড়াসহ বিভিন্ন পথে চলছে মালিকদের চাপিয়ে দেওয়া এই সিটিং সার্ভিস, লোকাল সিটিং ও গেটলক মিনিবাস। মিরপুর থেকে চয়েজ, আল মক্কা, শিখর, শিকড়সহ বিভিন্ন কোম্পানির মিনিবাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করতে দেখা গেছে। সায়েদাবাদ থেকে গাজীপুরে চলাচলকারী লোকালবাসগুলো হঠাৎ করে সিটিং বাস হয়ে গেছে। এসব বাসে সিটিং স্টিকার লাগিয়ে রাজপথে গণপরিবহনের নৈরাজ্য চলছেই। নাম সিটিং হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়াই রাস্তার মাঝেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে। এতে অফিসগামী সাধারণ যাত্রী চরম দুর্ভোগে পড়েন। ভাড়াও যেমন অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে, তেমনি সেবার মান খুবই ন্যূনতম বলে অভিযোগ করেছেন দুর্ভোগে পড়া যাত্রীরা।
বিআরটিসি বাসে বেশি ভাড়া : রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ বাসে নেই ভাড়ার তালিকা। মিরপুর-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী রাষ্ট্রায়ত্ত বিআরটিসির বাসে উঠেও দেখা যায় ভাড়ার তালিকা নেই। এই সরকারি বাসেও ভাড়া বেশি নেওয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে বেশ কয়েকটি রুটে গিয়ে দেখা যায়, নির্ধারিত যত টাকা বা পয়সা ভাড়া বাড়ার কথা, তার চেয়ে ২০ গুণ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে প্রতিটি গণপরিবহনে। স্বল্প দূরত্বের কোনো ভাড়া মানছেন না মালিকরা। মিনিবাসে প্রেস ক্লাব থেকে ফার্মগেটের ভাড়া হওয়ার কথা আট টাকা। বসুমতি, নিউভিশন পরিবহনে নেওয়া হচ্ছে ১২ টাকা। খিলগাঁওয়ের যাত্রী মানিক জানান, বিআরটিসির বাসে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হতে হয় যাত্রীদের। তাদের বাসে ১০ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নেই। জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিবাদ করলে যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। বিআরটিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের অধিকাংশ বাস লিজে চালানো হয় বলে বাড়তি ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
এ ছাড়া রাজপথে দেখা যাচ্ছে কম দূরত্বে যাত্রীদের গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে কখনো উত্তর দেয়, কখনো দেয় না। এ ছাড়া কিছু কিছু বাস নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে সিটিং। এরপর চলে লোকাল হিসেবে। বিভিন্ন রুটে এসব ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানি বেড়ে গেছে। বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ধার্য করলেও সঠিক ভাড়া আদায় করছেন না কেউই। যেমন ধরেন গুলিস্তান থেকে রামপুরা ভাড়া হচ্ছে ৮ টাকা। কিন্তু গণপরিবহনের চালকরা নিচ্ছেন ২০ টাকা। আর টাকা কম দিলে যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন তারা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধে আপনাদের কোনো পদক্ষেপ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরাই প্রথম গণশুনানির আয়োজন করেছি। তবে এ বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করেছি মিডিয়ার মাধ্যমে। যখন মিডিয়ায় এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়, তখন কর্তৃপক্ষের এটি নজরে আসে। তখন তারা ব্যবস্থা নেয়।’
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী বলেন, ‘সম্প্রতি এ বিষয়ে বেশি বেশি অভিযোগ আসছে। যাত্রী হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া ও সিটিং বাসের বিরুদ্ধে আমরা মাঠে নামব।’ এ ছাড়া যাত্রীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, কোনো বাসের হেল্পার-ড্রাইভার যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণ করলে ট্রাফিক পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে হবে। তখন তারা ব্যবস্থা নেবে।
লেখক: হাসান ইমন
No comments:
Post a Comment