কী হবে ৫ তারিখে?
আলোচিত ৫ জানুয়ারি ঘিরে আবারো উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে দেশের রাজনীতি। দিনটি ঘিরে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির ঘোষিত পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেখা দিয়েছে উত্তেজনাও। মূল কর্মসূচি রাজধানীতে হলেও সে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকার বাইরেও।
বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ‘বিএনপিকে কিছুতেই মাঠে নামতে দেওয়া হবে না’—এমন মন্তব্যের কারণে উত্তেজনা বাড়ছে দিন দিন। অপরদিকে যেকোনো উপায়ে বিএনপিও কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেওয়ায় রীতিমতো মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটি। যদিও রাজনৈতিকভাবে এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি শক্তিশালী ও মাঠের রাজনীতির পুরোটাই এই দলের কব্জায়; তবু বিএনপি বেঁকে বসলে সেই কর্মসূচি ঘিরে শেষ পর্যন্ত যেকোনো সহিংসতা ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফলে ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে কী হতে যাচ্ছে—এ নিয়ে নানা মহলে শুরু হয়েছে আলোচনা। অফিস-আদালতে, রাস্তাঘাটে কয়েক দিন ধরেই আলোচনাটি বাড়ছে। দিন যত যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি তত বেশি উদ্বিগ্ন হচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরাও। প্রথম বছরের মতো আবারো কি দেশ সেই জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির শিকার হতে যাচ্ছে; নাকি গত বছরের মতো শেষ পর্যন্ত সব উত্তেজনা কাটিয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই কর্মসূচি পালন করবে দল দুটি—এ প্রশ্ন এখন সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে।
এরআগে গত দুই বছরে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন নিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠত। গত বছর ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্মসূচি পালনে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উভয় দলের সমাবেশ করা নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিএনপিকে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়। আর আওয়ামী লীগ রাজধানীসহ সারা দেশে বিজয় র্যালি ও সমাবেশ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতায় গত বছর কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তবে প্রথম বছর নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে ২০১৫ সালে বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ এবং আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিলে তৈরি হয় উত্তেজনা। পুলিশ ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশের পথ বন্ধ করে দিলে খালেদা জিয়া টানা অবরোধের ঘোষণা দেন। এরপর তিন মাসে নজিরবিহীন সহিংসতা ও নাশকতায় দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়, যার পেছনে বিএনপিকেই দায়ী করে আসছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
আগামী ৫ জানুয়ারি সে নির্বাচনের তৃতীয় বর্ষপূর্তি। দিবসটি পালনে আবারো অনুরূপ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে দুই দল। গত ২৮ ডিসেম্বর কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আগামী ৫ জানুয়ারি রাজধানীসহ সারাদেশে কালো পতাকা মিছিল করবে তার দল। আর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ জানুয়ারি হবে সমাবেশ। অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার ২৯ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রের বিজয় দিবস পালন করা হবে। গণতন্ত্রের বিজয় দিবসে ঢাকায় দুটি সমাবেশ করব। একটি সমাবেশ হবে রাসেল স্কয়ারে হবে। এটি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের আয়োজনে হবে। অপরটি ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজনে সমাবেশ হবে। একই সঙ্গে তিনি ক্ষমতাসীন দলের জেলা শাখাগুলোকেও সমাবেশ করার আহ্বান জানান।
ফলে দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেখা দেওয়া উত্তেজনা রাজধানীসহ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিচ্ছেন, ঠিক সেই সময় এই পাল্টাপাল্টি সমাবেশের গুরুত্ব বেড়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। যদিও দুই দলই কৌশলী কর্মসূচি নিয়েছে, অর্থাৎ দুই দলের মূল কর্মসূচি সমাবেশ ভিন্ন ভিন্ন দিনে; তার পরও বিএনপির সেই সমাবেশ কিংবা কালো পতাকা মিছিলকে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা করছে আওয়ামী লীগ। সে কারণেই ন্যূনতম ছাড় দিতে চাইছে না দলটিকে। অবশ্য আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করবে না, এমন প্রতিশ্রুতি পেলে দলটিকে তাদের কর্মসূচি করতে দেওয়া যেতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কোনো ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা নেই বলে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মসূচি ‘রুটিন ওয়ার্ক’। এখানে সহিংসতার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিকভাবে এমন একটি অবস্থানে রয়েছে যে সামান্য কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট করবে না। কোনো কারণে বিএনপিকে পথে নামার কোনো ইস্যুও তৈরি করবে না। অন্যদিকে, বিএনপির অবস্থাও ভালো না। রাস্তায় নামতে যে সাংগঠনিক শক্তি দরকার, এই মুহূর্তে দলটির তা নেই। সুতরাং উত্তেজনা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত দুই দলই তাদের কর্মসূচি পালন করবে শান্তিপূর্ণভাবেই।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, বিএনপির যে কর্মসূচি তা দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বেশি করার কিছু নেই। তারা সংসদের বাইরে আছেন। বিগত দিনে তারা ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কর্মসূচি পালন করা নিয়ে পেছনে চলে গেছে। তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে কর্মসূচি পালনে মানুষের জানমালের ক্ষতিসহ সম্পদহানি করেছিলেন। এতে তাদের কোনো রাজনৈতিক লাভ হয়নি, বরং দেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়েছেন। এবারও তারা যদি শাসক দলের সাথে আপোষ করে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন না করে তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়ত তাদেরকে কঠোর হস্তে মোকাবিলা করবে। তারপরও উভয় দলের ঘোষিত কর্মসূচিতে আপাতত মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি পালনে কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
২০১৪-এর ৫ ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল বর্জন করে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট, জাতীয় পার্টিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ১২টি দল ওই নির্বাচনে অংশ নেয়। ভোটগ্রহণের আগেই দেশের ৩০০ আসনের ১৫৩টি আসনের সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ৫ জানুয়ারি ভোটের দিন ১৪৭ আসনে ভোট হয়। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট নির্বাচন বয়কট করে নির্বাচন বানচালের দাবিতে নির্বাচনের আগের তিন মাস এবং নির্বাচনের পরে কয়েক মাস সারা দেশে একযোগে আন্দোলন শুরু করে। নির্বাচনকেন্দ্রিক দেশি-বিদেশি নানা চাপের মুখে পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তার পরও ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার’ যুক্তিতে নির্বাচনবিরোধীদের মোকাবিলা করে দেশ পরিচালনায় মনোযোগী হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিএনপির দাবি, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছে। যে কারণে দশম সংসদ নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তির দিন অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে দিবসটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে দলটি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দাবি, দেশের সংবিধান সমুন্নত রাখতে ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প ছিল না। যদিও বিএনপিসহ দেশি-বিদেশি নানা চক্র চেষ্টা করেছিল ধ্বংসাত্মক পদ্ধতিতে নির্বাচন বানচাল করতে। কিন্তু বিরোধীদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি, শত বিরোধিতা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে দিবসটি ২০১৫ সাল থেকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে আওয়ামী লীগ।
আগামী ৫ জানুয়ারির কর্মসূচিকে ঘিরে কোনো জটিলতা না থাকলেও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগের ‘বিএনপিকে’ মাঠে নামতে না দেওয়ার ঘোষণায়। গতকাল দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, দশম সংসদ নির্বাচনের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে বিএনপিকে রাজপথে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না। এর আগে এই নেতা আরেক সভায় বলেন, জনগণ বিএনপিকে রাস্তায় নামতে দিবে না। বিএনপিকে এই দিবস নিয়ে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে রাজপথে নামতে দেওয়া হবে না। অন্যদিকে, বিএনপির কর্মসূচি হবে বলে দল ঘোষনা দিয়েছে। নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফের বক্তব্যের জবাবে ৫ জানুয়ারি কালো পতাকা মিছিল ‘সফল করার’ ঘোষণা দিয়েছেন রুহুল কবির রিজভী। শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, দলের পক্ষ থেকে ৫ জানুয়ারি সারাদেশে মহানগর-জেলায় কালো পতাকা মিছিল ও কালো ব্যাজ ধারণের যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা হবেই। আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্যের জবাবে এই বিএনপি নেতা আরও বলেন, আমাদের জেলা নেতৃবৃন্দ প্রস্ততি নিচ্ছেন। সকল নেতাকর্মীর সমন্বয়ের একটি সাফল্যমন্ডিত কর্মসূচি হবে। আগামী ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ জানুয়ারির সমাবেশও হবে, আইনি যে প্রক্রিয়া তাও চলছে। কিন্তু রাজপথে নামতে দেওয়া হবে না বলে শাসক দলের নেতারা যে বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটাই তো গণতন্ত্র হত্যার একটা দৃষ্টান্ত। নামতে দেবেন না কেন? ওইটা যদি গণতান্ত্রিক ভোট হয়ে থাকে, গণতন্ত্র মানেই তো সমাবেশ, গণতন্ত্র মানেই তো মিছিল।
No comments:
Post a Comment