বছরজুড়েই আলোচনায় ছিলেন এরশাদ
দেশের রাজনীতিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একজন রহস্য পুরুষ। সমালোচকদের মতে, এ রহস্যই এরশাদের রাজনৈতিক পুঁজি। সেই পুঁজি নিয়েই বাড়াতে চান নিজের কদর। বছরজুড়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক এ রাষ্ট্রপতি জন্ম দিয়েছেন অনেক বির্তকের। নিজ ভাই জি এম কাদেরকে দলে উত্তরসূরি ঘোষণা দিয়ে পড়েছিলেন ভাঙনের মুখে। আবার বছরের শুরুটা করেছিলেন বরখাস্ত হওয়া মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে পুনর্বার নিয়োগ দিয়ে। দূরে ঠেলে দেন একসময়ের প্রিয় পাত্র জিয়াউদ্দিন বাবলুকে। এমন সিদ্ধান্তের পরই রওশনের নেতৃত্বে সংসদে থাকা এমপিদের তোপের মুখে পড়েন এরশাদ। নিশ্চিত ভাঙনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় রক্ষায় পান বহুরূপী এরশাদ।
বছরজুড়ে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা বলেছেন এরশাদ। সমালোচকরা বলছেন, মামলা-মোকদ্দমা ও জেলে যাওয়ার ভয়ে স্বাধীনভাবে কিছু বলতে বা করতে পারেন না তিনি। জি এম কাদেরসহ দলের প্রভাবশালী একটি অংশ জাতীয় পার্টিকে সরকার থেকে বের করে আনতে চাইলেও পারছেন না রওশনের কারণে। সরকারে অংশীদারিত্ব থাকায় নিজ এলাকা উত্তরবঙ্গে ব্যাপক সমালোচনার মুখে আছেন এরশাদ। সম্প্রতি দলের এক যৌথসভায় এরশাদকে মামলা থেকে মুক্ত করার কথা জোর গলায় বলা হলেও কার্যত কিছু করছে না সরকারে থাকা জাপার মন্ত্রী-এমপিরা।
দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুকে ১৯ জানুয়ারি পদ থেকে অব্যাহতি দেন এরশাদ। দুই বছর পর সেই পদে আবারো পুনর্বহাল হন রুহুল আমিন হাওলাদার। এর আগে ১৭ জানুয়ারি ছোট ভাই জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ও দলের উত্তরসূরি ঘোষণা করেন তিনি। একই সঙ্গে জি এম কাদেরকে আহ্বায়ক ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সদস্য সচিব করে পার্টির ত্রিবার্ষিক সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিও ঘোষণা করেন। এ নিয়ে দলে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। পরদিন এরশাদের স্ত্রী ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলের একটি অংশের বিদ্রোহের মুখে পড়েন এরশাদ। দলের মহাসচিবের দায়িত্বে থাকা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও ১৮ জন সংসদ সদস্যসহ একটা অংশ ১৮ জানুয়ারি যৌথসভা করে এরশাদকে বাদ দিয়ে রওশনকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাবলুকে সরিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব করার পাল্টা সিদ্ধান্ত নেন এরশাদ।
পাল্টাপাল্টি এসব সিদ্ধান্তে টালমাটাল অবস্থায় পড়ে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। কথিত আছে, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে জাতীয় পার্টিতে চলা স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বের অবসান হয়। সমঝোতার অংশ হিসেবে রওশনপন্থিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দলের চেয়ারম্যান এরশাদ স্ত্রী রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। সে যাত্রায় এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদেরসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এরশাদের এমন সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়ায় নিশ্চিত ভাঙন থেকে রক্ষা পায় জাপা। জাপা শিবিরে নেমে আসে স্বস্তি।
যদিও সমালোচকরা মনে করেন, জাতীয় পার্টিতে এরশাদ-রওশনের দৃশ্যমান বিরোধ অনেকটাই কৌশলগত। দুই পক্ষের কেউই সরকারকে চটাতে চায় না; বরং সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই জাপাকে আলোচনায় জিইয়ে রাখতে চান তারা। এ জন্যই কিছুদিন পরপর দলের সংসদ সদস্যদের মন্ত্রিসভা ছাড়ার আলোচনা তোলা হয়। দলের সর্বশেষ বিরোধ নিয়ে সরকারে থাকা না থাকার প্রশ্ন উঠলেও এরশাদ নিজে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদে বহাল আছেন। তাই এরশাদ প্রায়ই বলছেন, বিশেষ দূত বানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে সম্মান দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া তিনি এ পদ ছাড়বেন না।
দীর্ঘ ৭ বছর পরে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত হয় জাপার ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল। মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যেই কাউন্সিল অধিবেশন সম্পন্ন করে দলটি। আর সেই চার ঘণ্টার কাউন্সিলেই কাউন্সিলরদের কণ্ঠভোটে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হন প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ ও কো-চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন জি এম কাদের। মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে। কমিটির বাকি পদগুলো পূরণের ক্ষমতা পেয়ে এরশাদ ঘোষণা করেন পূর্ণাঙ্গ কমিটিও। এরশাদ চাইলে তার চাহিদামতো নতুন নতুন পদও সৃষ্টি করতে পারবেন। গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে কাউন্সিলে এরশাদের ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে এবারের কাউন্সিল অধিবেশনে গঠনতন্ত্রে আরো কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। গঠনতন্ত্রের ২০নং ধারায় বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান প্রয়োজন মনে করলে দলে নতুন পদ তৈরি করতে পারবেন। এর ফলে চেয়ারম্যান হিসেবে দলে এরশাদের ক্ষমতা আরো বেড়ে গেছে। এর আগে কাউকে দল থেকে বহিষ্কার বা নিয়োগের ক্ষমতাসংক্রান্ত ৩৯ ধারায়ও চেয়ারম্যানের বিশেষ ক্ষমতা ছিল। ওই ধারা বলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে দল থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন এরশাদ। অনেককে আবার টেনে ওপরেও তুলেছেন তিনি। এ নিয়ে দলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বহুবার। এবারের কাউন্সিলে ৩৯ ধারা বাতিলের দাবিও উঠেছিল। কিন্তু সেই ৩৯ ধারাটির মধ্যে শিথিলতা আনার কথা থাকলেও সেটা করা হয়নি। বরং ৩৯নং ধারাটি ২০নং ধারায় অন্তর্ভুক্ত করে দেয়ায় এখন দলে আরো ক্ষমতা বেড়েছে এরশাদের।
বছরের শেষ সময়ে এসে জাতীয় পার্টি এখন নির্বাচনী রাজনীতি ব্যাস্ত আছে। বছরের শুরুর দিকে ভারত সফর করেন এরশাদ। তার কিছুদিন পরই জিয়াউদ্দিন বাবলুর নেতৃত্বে দলের কয়েকজন এমপিও সফর করেন ভারত। এ সফরের পরই দলটিতে হঠাৎই শুরু হয় নির্বাচনী তোড়জোড়। সিলেট থেকে নেমেছেন নির্বাচনী প্রচারেও। বিভিন্ন আসনে দিচ্ছেন মনোনয়ন। সময়ে সময়ে দলের এবং দেশের অবস্থা জানতে দলীয় নেতাদের দিচ্ছেন চিঠি। সম্প্রতি নির্বাচন নিয়ে এরশাদের তৎপরতা আরো বেড়েছে। হঠাৎ কী করছেন এরশাদ, জাননে না দলটির নেতারাও। দলের সিনিয়র নেতারাও জানেন না এরশাদ গতিবিধি।
জাতীয় পার্টি গত দুই মেয়াদের সরকারের সঙ্গে আছে। আগামীতেও দলটি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটির পক্ষে থাকতে চায়। তিনশ আসনে প্রার্থী দিবে, এককভাবে লড়বে। মানুষ জাতীয় পার্টিকে গ্রহন করেছে। বছরজুড়ে এ জাতীয় কথা ও কাজের মাধ্যমে এরশাদ তার রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়াতে চাচ্ছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে আগামী নির্বাচনে কী হবে তাদের লক্ষ্য, তা নিয়ে সম্প্রতি তোড়জোড় বেড়ে যায় এরশাদের। হঠাৎ করে কেন এত নির্বাচনী তোড়জোড় তা জানতে দলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আসল রহস্য। নেতাদের মতে এরশাদের যত ভাবনা আগামী নির্বাচন এবং সরকার নিয়ে। তিনি চান পরবর্তী সরকারের সঙ্গেও যাতে বর্তমানের মতো গাটছড়া বাধা যায়। এ লক্ষ্যে, নানান হিসেব-নিকেষ করছেন তিনি। নেতারা জানান, তার যত ভয় নিজেকে নিয়ে। নিজের মামলা এবং সাজা নিয়ে। যে কোনোভাবেই তিনি থাকতে চান ক্ষমতার সঙ্গে।
সমালোচকদের মতে, জাপার রাজনীতিতে ভারতের পরামর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এরশাদ নিজেও এসব পরামর্শকে গুরুত্ব দেন। ভারত সফরের আগে জাপা সরকারের ভেতর থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে বেশ সরব ছিল। নিজ ভাই জি এম কাদেরও সরকার থেকে বের হতে চাচ্ছিলেন। এর জন্য বৃহত্তর রংপুর জাপার পক্ষ থেকে চাপও ছিল এরশাদের প্রতি। তারপরই দলের পরবর্তী করণীয় জানতে ভারত সফর করেন এরশাদ। কিন্তু সে যাত্রায় কোনো নির্দেশনা পাননি এরশাদ। বলা হয়েছে আপাতত সরকারের সঙ্গে থাকতে।
এ অবস্থায় জাপা নেতাকর্মীরা এখন সরব হচ্ছে এরশাদকে মামলা থেকে রক্ষার দাবি তুলতে। সম্প্রতি এক যৌথসভায় রওশন, এরশাদকে মামলা থেকে রক্ষার ঘোষণা দেন। তাতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাই নতুন বছরের শুরুতে এরশাদ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দীতে ১০ লাখ লোকের সমাবেশ করে পালন করতে চান প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আর সেই সমাবেশ থেকে মামলার শৃঙ্খল থেকে নিজেকে বের করে আনার রাজনীতি শুরু করতে চান এরশাদ। সেই সঙ্গে সরকারি দলের সঙ্গে দর কষাকষির রাজনীতিও জোরালো করতে চান।
No comments:
Post a Comment