অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধার কথা
তার পারিবারিক নাম সালাউদ্দিন মাহমুদ মামুন। নিজের ইচ্ছায় নামের পরিবর্তন করে রাখেন মামুন মাহমুদ। তার বাবা ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। পাকিস্তান সরকারের সার্জন জেনারেল ছিলেন। মায়ের নাম শামসুন নাহার মাহমুদ। মামাদের মধ্যে পরিচিতজন হাবিবুল্লা বাহার। তিনি পাকিস্তান আমলে মন্ত্রী ছিলেন। ঢাকার হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ তার নামে প্রতিষ্ঠিত। ছোট ভাই মঈন মাহমুদ। শামসুন নাহার মাহমুদের মার নাম আছিয়া খাতুন। পিতার নাম মোহাম্মদ নুরুল্লাহ্ (মুনসেফ)। তার বাড়ি ফেনীর পরশুরামের উত্তর গুতুমা গ্রামে। ছোটবেলায় পিতার মৃত্যুর পর ১৭ বছর বয়সী বিধবা মা আছিয়া খাতুন ২ সন্তানসহ বাবা খান বাহাদুর আবদুুল আজিজ বিএ-এর চট্টগ্রামের তামাকুমন্ডি লেইনের বাসায় ওঠেন। এরপর ওখানেই থিতু হন। শামসুন নাহার ও ইকবাল বাহারের ওখানেই লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা। ব্রিটিশ শাসনকালে নোয়াখালীর অধিবাসী আবদুুল আজিজ চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেছেন। ১৮৯১ সালে তিনি চট্টগ্রামে মোহামেডান এডুকেশন সোসাইটি স্থাপন করেন। ১৮৯৯ সালে ওই সোসাইটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি। তিনি চট্টগ্রামের বর্তমান নিউমার্কেটের কাছাকাছি তামাকুমন্ডিস্থ খান বাহাদুর আবদুুল আজিজ লেনে বাড়ি করেছিলেন। তার নামেই এ রাস্তার নামকরণ। বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ তার নাতনি। জামাতা ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ চাকরির কারণে কলকাতায় থাকতেন। শামসুন নাহারের লেখালেখির হাত ছিল। তা ছাড়া তৎকালীন নারী আন্দোলেনের পুরোধা বেগম রোকেয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। হাবিবুল্লাহ বাহারের সঙ্গে কলকাতা থেকে কবি নজরুলের বন্ধুত্ব ছিল। সে সুবাদে ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের পরিবারে কবি নজরুলের যাওয়া-আসা ছিল। এ সূত্র ধরেই ১৯২৬ সালে কবি নজরুল প্রথমবার চট্টগ্রাম এলে হাবিবুল্লাহ বাহারদের তামাকুমন্ডিস্থ বাসায় অবস্থান করেন।
শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুুল আজিজের উদ্যোগে তৎকালীন মুসলিম সমাজে শিক্ষার বিস্তার লাভ হচ্ছিল মাত্র। কবি নজরুল ইসলাম তার এ উদ্যোগকে একটি মহান কর্ম তৎপরতা বলে মনে করে তার ঔদার্য্যে আপ্লুত হয়ে সন্ধ্যাকাব্য নামক গ্রন্থে ‘বাংলার আজিজ’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
‘পোহায়নি রাত, আজান তখনো দেয়নি মুয়াজ্জিন,
মুসলমানের রাত্রি তখন আর সকলের দিন।
অঘোর ঘুমে ঘুমায় যখন বঙ্গ মুসলমান
সবার আগে জাগলে তুমি গাইলে জাগার গান।’
১৯২৮ সালের ১৭ নভেন্বর তামাকুমন্ডিস্থ নানার বাড়িতে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদের প্রথম সন্তান ‘সালাউদ্দিন মাহমুদ মামুনের’ জন্ম হয়। ১৯২৯ সালের প্রথম পাদে কবি নজরুল দ্বিতীয়বার চট্টগ্রাম এলে এ বাড়িতে অতিথি হন। শামসুন নাহার মাহমুদের সদ্যোজাত ছেলে মামুন মাহমুদকে স্বাগত জানিয়ে কবি শিশু জাদুকর নামে নিমোক্ত কবিতাটি রচনা করেন।
‘পার হয়ে কত নদী কত যে সাগর
এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর
কোন রূপলোকে ছিলি রূপকথা তুই!
রূপ ধরে এলি এই মমতার ভূঁই।’
এখানে কবির থাকার কক্ষের পাশের জানালা দিয়ে দেখতেন সুউচ্চ সারি সারি সুপারি গাছে পাতার নাচন আর বাতাসের আন্দোলন। এবার কবি লিখলেন ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ নামক সুদীর্ঘ কবিতাটি। এ কবিতায় শেষের দিকে কবি লিখেছেন-
‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না
কোলাহল করি, সারাদিন মান কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না’
হয়তো কবি তার জীবনের শেষ পরিণতির দিনগুলোর কথাই এ কবিতায় তুলে ধরেছিলেন অবলীলায়। ১৯৩৩ সালের প্রথম দিকে কবি এ বাড়িতে আসেন তৃতীয়বার অর্থাৎ শেষ বারের মতো। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘সিন্ধু হিল্লোল’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে লেখেন।
‘কে তোমাদের ভালো ?
বাহার আনে গুলশানে ‘গুল’ ‘নাহার’ আনে আলো।
‘বাহার’ এলে মাটির রসে ভিজিয়ে সবুজ প্রাণ,
‘নাহার’ এলে রাত্রি। চরে দিনের অভিযান।
তোমরা দু’টি ফুলের দুলাল আলোর দুলালী,
একটি বোঁটায় ফুটলি এসে নয়ন ভুলালী।
নামে নাগাল পাইনে তোদের নাগাল পেল বাণী,
তোদের মাঝে আকাশ ধরা করছে কানাকানি।
মামুন মাহমুদের সাড়ে ৫ বছর বয়সে ১০-০৮-১৯৩৪ তারিখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন।
c/o : ডা. মাহমুদ, ১০/৮/৩৪
কবি,
আমি একটা ছোট ছেলে। বয়স সাড়ে পাঁচ। আমার মা ও মামা বুলবুল সম্পাদক। আমি তোমার ‘সহজপাঠ’ পড়েছি। বড় হলে তোমার সব বই পড়ব। তুমি নাকি ছোটদের খুব ভালবাস। তাহলে আমার চিটির জবাব দিও। আমি আরেকটু বড় হলে শান্তি নিকতনে তোমায় দেখতে আসব।
ইতি
মামুন মাহমুদ
কবি রবীন্দ্রনাথ সেই চিটির উত্তর দেন ১৭ আগস্ট ১৯৩৪ সালে।
বৎস,
তুমি যখন আমার সহজপাঠ পড়েছ তখন বিনা পরিচয়েই আমার সঙ্গে তোমার জানাশোনা হয়ে গেছে। তাই এখন থেকেই তোমাকে নিমন্ত্রণ করে রাখছি, বয়স হলে শান্তি নিকেতনে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসো-হয়তো দেখা হতেও পারে-খুব শীঘ্র করে যদি বড় হতে পার তাহলে সাক্ষাৎ অসম্ভব হবে না। তাই বলছি, খুব তাড়া কর। ইতি ১৭ আগষ্ট ১৯৩৪
শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবির আর্শীবাদপুষ্ট সেদিনের ‘শিশু যাদুকর মামুন মাহমুদ’ ১৯৪৩ সালে কলকাতা বালিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। পাকিস্থানের জন্মের পর ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক রিলেসান বিষয়ে এম.এ পাশ করেন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসে এএসপি পদে নিযুক্ত হয়ে পুলিশ একাডেমি সারদাহ এ ট্রেনিং এ যোগদান করেন।
চাকুরী জীবনে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাঙামাটি, ফরিদপুর, খুলনা, ময়মনসিংহে কাজ করেছেন।
১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে কাজ করেছেন। এসময়ে একজন জাতীয় পরিষদ সাংসদ এর গুদাম থেকে বিপুল পরিমান সরকারি আমদানিকৃত ইলেকট্রিকের চোরাই তার উদ্ধার হলে এ ব্যাপারে সরকারি উচ্চ মহল থেকে তাকে তদন্ত ভার দেওয়া হয়। আসামী গ্রেফতারের পারমিশন চাইলে প্রভাবশালী এ মুসলিম লীগ নেতার তদবিরে তাকে সত্তর বদলী করে দেওয়া হয়। ১৮-০১-১৯৬৭ থেকে ২১-০১-১৯৭০ পর্যন্ত তিনি ঢাকা জেলার এসপি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ এর প্রথম দিকে তিনি ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে রাজশাহী রেঞ্জে যোগদান করেন। ১৯৭১ এর মার্চে অসহযোগ আন্দলনের উত্তাল সময়টিতে তিনি অসম সাহসীকতায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
১৯৭১ এর ২৬ মার্চ রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ ডিআইজি মামুন মাহমুদকে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার রংপুরে রিপোর্ট করতে ওয়ারলেস মেসেজ দেন। একই সন্ধ্যায় একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের অধিনায়কত্বে একদল পাকসেনা তার বাসভবন ঘেরাও করে তাকে বন্দি করে রংপুর নিয়ে যায়। এর পর থেকে তিনি নিখোঁজ। তার মৃত্যুর তারিখ জানা যায়নি। লাশও পাওয়া যায়নি।
বাবার মৃত্যু সম্পর্কে তার মেয়ে জেবা মাহমুদ লিখেছেন-
‘... আমার বাবা ছিলেন রাজশাহী বিভাগের ডিপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, একজন সরকারী উচ্চপদস্থ অফিসার হয়েও তার সরকারী বাসবভন ও অফিসে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ মাসের প্রথম থেকেই কালো পতাকা নিজ হাতেই উত্তোলন করেছিলেন। তা ছাড়া ২৫ মার্চের আগের সপ্তাহে গণআন্দোলনে সহায়তা করার প্রচেষ্টায় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও বাঙালি কর্মকর্তাকে নিয়ে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছেন কয়েকবার। কিন্তু সবকিছু গোপন থাকেনি। ২৬ মার্চ সন্ধ্যার সময় হানাদার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন এস বলে যে ডিআইজি সাহেবের সঙ্গে রংপুর থেকে ব্রিগেডিয়ার ওয়্যারলেসে কথা বলবেন। বাবা নিজের জিপে, চালক ও দেহরক্ষীসহ চলে গেলেন। তিনি গেলেন সন্ধ্যায় আধো আলো, আধো ছায়ার মধ্যে। আর ফিরে এলেন না। যে দানবের হাত থেকে তিনি দেশকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তাদের গোপন হিংসার আঘাতে কপট রাত্রির আড়ালে চিরতরে হারিয়ে গেলেন... ২৬ মার্চ ছিল আমার বাবামায়ের বিবাহবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ আমাদের সবার জন্য কিছু বই কিনে এনেছিলেন। আমার জন্য ছিল কাল মার্ক্সের শর্ট বায়োগ্রাফি ও লেনিন। ২৫ মার্চের সেই কালরাতে তিনি বই দুইটিতে লাল কালি দিয়ে লিখেছিলেন,.. লেনিনের বইটিতে লেখা ছিল, যেবা, দিস ইজ অ্যাবাউট এ ডেভোটেড লিডার অব এ ভ্যালিয়ান্ট পিপল হু ওয়ান্টস স্ট্রাগলড ফর ইম্যানসিপেশন ফ্রম এক্সপ্লইটেশন লাইক দ্য পিপল অব বাংলাদেশ টুডে।’
অকুতোভয় শহীদ এ মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ অফিসারকে ২০১৫ সালে মরণোত্তর জাতীয় ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ সম্মানিত করা হয়।
লেখক: আহমেদ আমিন চৌধুরী
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অব.)
No comments:
Post a Comment