আমাদের আপনজন
সৈয়দ শামসুল হক আমাদের অত্যন্ত আপনজন ছিলেন। তার কারণ তার সাহিত্যচর্চা। তিনি তার সকল পাঠকের মন জয় করেছেন এবং তাদের সঙ্গে থেকেছেন। শামসুল হক নিজে সর্বক্ষণ সাহিত্যের সঙ্গে থাকতেন। সার্বক্ষণিক সাহিত্যিক, মনেপ্রাণে সাহিত্যিক বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা-ই। অন্য অনেক কাজ করেছেন, ছিলেন সাংবাদিকতার জগতে, কাজ করেছেন চলচ্চিত্রে, যুক্ত ছিলেন বেতার ও টেলিভিশনের সঙ্গে; সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্তব্যপালনে কোনো দ্বিধা ছিল না তার। কিন্তু সাহিত্যই ছিল তার কাজের ও বসবাসের প্রধান ক্ষেত্র।
তার ভেতরে একজন কবি ছিল। কল্পনায়, উদ্ভাবনায়, আবেগে, সৌন্দর্যচেতনায় এই কবিকেই আমরা তার সাহিত্যে সবসময়ে পাই। সাহিত্যের বাইরে শামসুল হকের সকল কাজের মধ্যেই কাব্যিক শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য দেখতে পাবো।
সাহিত্য তাকে অনুক্ষণ দুটি কাজে ব্যস্ত রেখেছে। একটি হচ্ছে নিজের সাহিত্যকর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া; অপরটি সাহিত্যের জন্য উপাদান ও জ্ঞান সংগ্রহ করা। সাহিত্যের সব শাখাতেই তার কাজ আছে; এবং যে-কাজই করেছেন অত্যন্ত যত্নের সাথে করেছেন। আঙ্গিক নিয়ে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিরাম ছিল না। ভাষা ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। চিন্তা করতেন শব্দের অর্থ ও অনুষঙ্গ নিয়ে, ভাষার ব্যবহার নিয়ে; চিন্তাগুলোকে লিখে রাখতেন। সে-বিষয়ে পত্রিকায় লিখেছেন, বই প্রকাশ করেছেন। তার নিজস্ব সাহিত্যিক রীতিটি ক্রমাগত প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হচ্ছিল। এমন সজাগ লেখক আমরা কম পেয়েছি।
কিন্তু রীতিই যে সাহিত্য নয় এই বোধের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাই সাহিত্যের জন্য উপাদান সংগ্রহে সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। এখানেও তার কোনো আত্মতৃপ্তি ছিল না। উপাদান আসতো জীবন থেকে, আসতো গ্রন্থপাঠ থেকে। তার কাছে জীবন ও গ্রন্থপাঠ ছিল পরস্পরের পরিপূরক। মানুষের সঙ্গে অবাধে মিশতেন, এবং ক্লান্তিহীনভাবে বই পড়তেন। ধ্রুপদী সাহিত্যের সঙ্গে তিনি হালের লেখাও পড়তেন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে। তার সংগ্রহশালাটি ছিল ক্রমসম্প্রসারণশীল। কিন্তু প্রতিটি সংগ্রহকেই সৈয়দ শামসুল হক মূল্যায়ন করতেন, এবং কাজে লাগাতেন। তার জন্য সাহিত্যের রীতি ও সাহিত্যের জন্য সংগ্রহ, এ দুটি ব্যাপারের ভেতরের সম্পর্কটা ছিল দ্বান্দ্বিক, একটি অপরটিকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যচর্চা যে কেবল রচনাকুশলতার ব্যাপার নয়, যথার্থ সাহিত্য যে জ্ঞান ও দার্শনিকতা দাবি করে, এটি ছিল তার একেবারে প্রাথমিক উপলব্ধি। তার সকল রচনাতেই ওই উপলব্ধির অসাধারণ প্রকাশ ঘটেছে।
সৈয়দ শামসুল হকের লেখা আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকবে। আর ব্যক্তিগতভাবে আমরা যারা তাকে জানতাম তাদের জন্য তিনি ছিলেন উষ্ণ হৃদয় এক বন্ধু। আমি নিজে সৌভাগ্যবান যে, তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কৈশোরে; ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে। আমাদের সময়ে সদরঘাট ছিল স্কুলপাড়া। পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোও ছিল ওখানেই। সৈয়দ হক ও আমি ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে পড়তাম, কিন্তু ম্যাট্রিকে আমাদের সিট পড়েছিল একই জায়গায়, তখনকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে, এখন যেটা কবি নজরুল কলেজ। সিট পড়েছিল পাশাপাশি বেঞ্চে। সেই পরিচয় পরে বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে, এবং ছেষট্টি বছর ধরে অক্ষুণ্ন রয়েছে।
শেষ কথা হয়েছে আনোয়ারা সৈয়দ হকের মোবাইল ফোনে, সৈয়দ হকের মৃত্যুর চার পাঁচ দিন আগে। কানে ভেসে এলো সেই একই কণ্ঠস্বর, স্পষ্ট ও দৃপ্ত। কে বলবে সে মৃতুপথযাত্রী। কথা বললো আগের মতোই গুছিয়ে। বললো অসুস্থ অবস্থাতেই হ্যামলেট নাটকটির অনুবাদ শেষ করেছে, এবং অন্য কাজও করেছে সেই সঙ্গে। না-দেখেও দেখতে পেলাম সেই কাজের মানুষটিকে যাকে প্রথম দেখি পাশের বেঞ্চে বসে মাথা নিচু করে লিখছে, এবং কাগজ চেয়ে নিয়ে আরো লিখছে, যেন সব প্রশ্নের উত্তর তার নখের ডগায়। ওই কিশোরটি যে কালে অতবড় লেখক হবে জানবার কথা নয়, কিন্তু সে যে সাধারণ নয় সেটি তার বসবার, লিখবার, অতিরিক্ত কাগজ চেয়ে নেবার ভঙ্গিতে বিলক্ষণ টের পেয়েছিলাম।
শেষ আলাপে সৈয়দ হক মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছে তার কথা বলেছিল, সে ভালোবাসা তার জন্য অক্ষুণ্ন থাকবে।
আমাদের সময়ে ঢাকা শহর আড়মোড়া ভাঙছিল। সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যে ওই শহরের সমাজ আছে, কিন্তু আছে শহরের বাইরে জনজীবনও, রয়েছে আমাদের ইতিহাস। তার পরানের গহীন গভীরে বাংলাদেশ সমুপস্থিত। আমরা টের পাই এবং জানি যে, সৈয়দ হক আমাদের অতিশয় আপনজন।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী,ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments:
Post a Comment