সরকারের খাদ্য সংগ্রহ
গত সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই চালের দাম কেজিপ্রতি দু-এক টাকা করে বাড়ছিল। অক্টোবরে এসে এক লাফে ১০-১২ টাকায় পৌঁছায়। গত মাসেও বাজারে যে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ২৮ টাকা, মঙ্গলবার বাজারে সে চাল কিনতে হয়েছে ৪০ টাকায়। অর্থাৎ গত মাসের তুলনায় এ মাসে সাধারণ মানুষকে গুনতে হচ্ছে মনপ্রতি ৪৮০ টাকা বেশি। সেইসঙ্গে সরু চালের দামও বেড়েছে মানভেদে কেজিপ্রতি ৭-১০ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মেসার্স সোহেল রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সোহেলসহ বেশ কিছু আড়তদার জানান, বাজারে চাহিদা অনুযায়ী চাল আমদানি নেই। পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে গেছে। সে কারণে আড়তদারদেরও বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও।
চাল ব্যবসায়ী ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে চালের দাম বাড়ার দুটি কারণ জানা গেছে। একটি হলো—এ মুহূর্তে সরকার বাজার থেকে ধান ও চাল সংগ্রহ করছে বা কিনছে। সরকারের কাছ থেকে বেশি দাম পাওয়ায় ব্যবসায়ীদের চাল ও ধান চলে যাচ্ছে সরকারের গোডাউনে। খোলাবাজারে চালের সরবরাহ কমছে। ফলে সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, সরকার হতদরিদ্র মানুষকে ১০ টাকা কেজি দরে যে চাল দিচ্ছে, সে চালও কিন্তু বেশি দাম দিয়ে ওই একই মিলমালিকদের থেকেই কেনা। সে কারণেও চালের সংকট দেখা দিয়েছে। খুচরা ও পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়ার এটিও একটি কারণ।
তবে দাম বাড়ার পেছনে ধান-চাল সংগ্রহে সরকারের ভুলনীতিকেই দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের ফেলো ড. গোলাম রাব্বানী বলেন, সরকার মৌসুমের সময় চাল ও ধান সংগ্রহ না করায় একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী অতিরিক্ত মুনাফা করতে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যে সময় কৃষকরা ধান তোলে তখন সরকার ধান-চাল কেনেনি। ফলে সে সময় এসব মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান-চাল সংগ্রহ করে গুদামজাত করে। এখন সরকার তাদের কাছ থেকেই বেশি দামে ধান-চাল কিনছে। ফলে একদিকে যেমন কৃষকরা ধান-চালের দাম পাচ্ছে না; তেমনি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এসব মধ্যস্বত্বভোগীই বাজারে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হিসাবে এবার প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে কৃষক পর্যায়ে খরচ হয়েছে ২০ টাকা ৭০ পয়সা। সরকার কৃষকের কাছ থেকে ২৩ টাকা কেজি দরে ধান এবং ৩২ টাকা দরে চাল সংগ্রহের ঘোষণা দেয়। একজন কৃষক সর্বোচ্চ তিন টন ধান সরবরাহ করতে পারবেন। এ বছরই প্রথম সরবরাহ করা ধানের মূল্য কৃষকদের নিজ নিজ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধ করার নিয়ম করা হয়েছে। ৫ মে থেকে শুরু হয়ে সংগ্রহ অভিযান চলার কথা ছিল ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। দুই দফা সময় বাড়িয়ে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়।
এ বছর ধান ও চোল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ লাখ টন। এর মধ্যে ধান ৭ লাখ ও চাল ৬ লাখ টন। এর মধ্যে ৫ মে থেকে শুরু করে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত সরকার বোরো ধান সংগ্রহ করেছে ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫৭৭ টন এবং বোরো চাল সংগ্রহ করেছে ৫ লাখ ২১ হাজার ৮৮৯ টন। এজন্য জেলা খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা ধান সংগ্রহ করা হবে এমন কৃষকদের তালিকা করে ও সেসব কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেন। সারা দেশে ৬৩০টি সংগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫০ অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকসংখ্যক কেন্দ্রেই সংগ্রহ করা হয়। বাকি কেন্দ্রগুলো সচল নয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য মতে, গত বোরো মৌসুমে ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৪৩ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। যার মধ্যে ১ কোটি ৫৬ লাখ টন হাইব্রিড, ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার টন উফশী এবং ৯৮ হাজার টন স্থানীয় জাতের চাল উৎপাদন হয়েছে।
কিন্তু কৃষকরা জানিয়েছেন, ফসল ওঠার পরে কার্ডধারী কৃষকদের থেকেই ধান সংগ্রহ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। ফসল ওঠার পর সরকার বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সে সময় ধান সংগ্রহ না করে এখন করছে। অথচ এখন আমন, ইরি ও বোরো ফসল ওঠার সময় নয়। আরো এক মাস পরে আমন ফসল উঠবে। ফলে কৃষকদের পরিবর্তে সরকার এখন একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করছে। কৃষকদের পরিবর্তে লাভ যাচ্ছে তাদের পকেটে।
কৃষকরা আরো জানিয়েছেন, সে সময় সরকার সরাসরি কৃষকদের থেকে ধান কিনলে কৃষকরা ন্যায্য দাম পেতেন। সে টাকায় ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য শ্রমিকের মজুরি, বাকিতে নেওয়া সেচ-সারের দাম, সংসারের খরচ ও ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারতেন। অথচ সে সময় ধান নিয়ে বাজারে গেলে দাম পাননি কৃষক। কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচই ওঠেনি। বিঘাপ্রতি লোকসান হয়েছে ২-৫ হাজার টাকা। পাওনাদারের চাপের কারণে কম দামেই ধান বিক্রি করতে হয়েছে।
ড. গোলাম রাব্বানী আরো বলেন, কৃষকদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছে ফড়িয়া ও দালালরা। কম দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে গোলা ভরেছে। সরকারের লোকজন এখন সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে, কিন্তু এখন কৃষকদের কাছে ধান নেই। কিনছে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের কাছ থেকে। কৃষকের আর লাভের মুখ দেখা হলো না। উৎপাদনের সঙ্গে যোগ না থাকলেও লাভের পুরোটাই পকেটে ভরছে ফড়িয়া-দালালরা।
সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন জেলার কৃষকরা তাদের প্রকৃতচিত্র তুলে ধরেছেন আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের কাছে।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, কৃষকের কাছে এখন ধান নেই, অথচ সরকার ধান কিনছে। ফেলে ধানের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। সরকার বেশি দাম দিয়ে ফড়িয়াদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করছে। ফসল ওঠার পরে সরকার কৃষকের কাছ থেকে না কেনায় কম দামে ফড়িয়ারা ধান কিনেছে। আর কোনো উপায় না পেয়ে অসহায় কৃষক বাধ্য হয়ে তাদের কাছে ধান বিক্রি করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুক্তারুল ইসলাম মুক্তি বলেন, কৃষকদের ঘরে কোনো ধান নেই। তারাই এখন চাল কিনে খাচ্ছেন। চার মাস আগে বোরো মৌসুমের ধান উৎপাদনের পর ব্যবসায়ী ও মিলমালিকরা ধান কিনে মজুদ করে রেখেছেন। ৫০০ টাকা ধান কিনে ব্যবসায়ী ও ফড়িয়া এখন হাজার টাকা মণে বিক্রি করছেন। অনেক মিলমালিকও ধান কিনে গুদাম ভরে রেখেছেন।
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, সদর উপজেলার চরশেরপুর নিচপাড়া গ্রামের গুদামে ধান দেওয়ার তালিকাভুক্ত কৃষক খোকা মিয়া বলেছেন, তালিকায় তার নাম ও সময় থাকা সত্ত্বেও গুদামে ধান নিয়ে গেলে সদর গুদামের এসএমও জানিয়ে দেয় ধান নেওয়া শেষ। তাই তিনি ধান দিতে পারেননি। একই গ্রামের কৃষক খোকনেরও একই অভিযোগ। এ ছাড়া সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ভুক্তভোগী অন্য কৃষকরা জানান, ধান উৎপাদনে কৃষকদের যে পরিমাণের খরচ হয় বাজারে তা বিক্রি করে আসল টাকাই ওঠে না। গুদামে সরকারের নির্ধারিত ৯২০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারলে তাদের আসল টাকা উঠত। কিন্তু সে সুযোগ কৃষকরা পাননি। এ কারণে তারা ধান উৎপাদনে অনাগ্রহ হয়ে উঠেছেন। অনেক কৃষক অভিযোগ করেন, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতাকর্মীর মাধ্যমেও ধান সংগ্রহ করা হয়।
কৃষক রহিমউদ্দিন জানান, চাষিরা যখন ধান বিক্রি করে দেন, তখন সরকার ধান-চাল কেনার ঘোষণা দেয়। প্রতি বছরই একই সময় সরকার এ কার্যক্রম ঘোষণা করে। এতে কৃষকদের লোকসান গুনতে হয়। আর লাভবান হন চাতাল ব্যবসায়ীরা।
আমবাগান এলাকার কৃষক হাকাম হীরা বলেন, সরকার এখন গুদামজাত করতে ধান কিনছে, এখন কৃষকের ধান নেই। ধান আছে মিলার আর মজুদদারদের কাছে। ফসল ওঠার পর কয়েকদিন ধরে ধান বিক্রির জন্য বাজার ঘুরেছি। কিন্তু খরচের সঙ্গে দাম মেলেনি। এক একর জমিতে ধান ফলাতে ২৬-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর বাজারে এখন ধান বিক্রি হচ্ছে বিআর-২৮, ২৯ ধান ৫১০ থেকে ৫২০ টাকা মণ দরে। মোটা হাইব্রিড জাতের ধানের দাম মণপ্রতি ৩৬০-৩৮০ টাকা। প্রতি একর ধান কাটতে সাত-আট হাজার টাকা মজুরি দিতে হয়েছে। এক মণ ধান বিক্রি করে একটা কামলার বেতনও হয় না।
কিন্তু কৃষকদের অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা জিএম ফারুক পাটোয়ারী বলেন, প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকেই ধান সংগ্রহ করেছি এবং তাদের ব্যাংক হিসাব বরাবর টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এবার জেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ২৪ হাজার ৫৭৭ টন। এ পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ১৪ হাজার ৩০৯ টন। সংগ্রহ শেষ হবে ৩১ অক্টোবর।
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, জেলার তারাকান্দা উপজেলার কৃষক দুলাল মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ হয় ৬০০-৭০০ টাকা। ধান মাড়াই মৌসুমে এক মণ ধান বিক্রি করতে হয় ৪০০-৫০০ টাকা। যার ফলে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধান চাষের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।
ফুলপুরের কৃষক শাহজাহান মিয়া বলেন, সরকারিভাবে কৃষকদের যে তালিকা করা হয় সেখানে প্রকৃত কৃষকের নাম নেই। সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও মিলমালিকরা ভুয়া তালিকা করে সরকারকে ধান সরবরাহ করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
জেলা খাদ্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলায় ৩২ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৮ হাজার টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকি চাল সংগ্রহের কাজ চলছে। কৃষকের কাছে ধান না থাকায় মিলমালিকদের কাছ থেকে সরাসরি চাল নেওয়া হচ্ছে বলে জানান জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মাহবুর রহমান।
No comments:
Post a Comment