Sunday, October 30, 2016

রিকশায় চলে ফাতেমার জীবন

‘১১ বছর আগে এক দিন সাহস করে প্রতিবেশী একজনের রিকশার চালকের আসনে উইঠা পড়ি। কিছুদূর চালানোর পর মনে হইলো, অভাবের সংসার চালানোর চাইতে এ কাজটা আমার কাছে সহজ। গাড়ি একটা বাসার কাছে ফেলায় রাখছে। সাহস করে উইঠা চালাইছি। শিখা হইয়া গেছে। এরপর ফয়স লেক এলাকা থেকে রিকশা নিয়ে ভাড়া মারা শুরু করছি। এখন রিকশা চালাইয়া কোনোমতে দিন চইলা যাইতাছে।’
কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম শহরের একমাত্র নারী রিকশাচালক ফাতেমা। তাকে সবাই সম্মানের সঙ্গে ডাকেন ফাতেমা খালা। সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে রিকশার হাতল ধরে দিনভর ছুটে চলেন নগরীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।
কুমিল্লায় স্বামী-সংসার নিয়ে একসময় ভালোই চলছিলেন ফাতেমা। কিন্তু ১৬ বছর আগে স্বামী আরেকটি বিয়ে করে সংসার ছেড়ে যাওয়ায় ওলটপালট হয়ে যায় সবকিছু। ফাতেমার সর্বশেষ ছেলেটি তখন অনেক ছোট্ট। এর কয়েক বছর পর তিন ছেলেসন্তান নিয়ে ফাতেমা চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। এত কিছু থাকতে রিকশা চালানো পেশা কেন? সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরটা দিলেন ফাতেমা, ‘বাসায় কাম লইছি, দুই হাজারও দেয় না বাবা, ১৫শ দেয়, পোষায় না। নানা খরচা আছে, ঘর ভাড়া আছে, খানার খরচ আছে, পোশাক আছে। গার্মেন্টসে চাকরি করতাছি, তখন তিন হাজার টাকা দিছিল। এই আয়েও পোষায় না দেইখ্যা এই রিকশা ধরলাম। ব্যাটারি রিকশা আছিল না তখন, পায়ে চালাইতাম। বেশি কষ্টের কাম অপুত।’কণ্ঠটা ধরে আসে ফাতেমার। খানিক পর আবার বলা শুরু করেন, এই রকম আছিলাম না তো, তারা (পাশের টং দোকানদাররা) কইতে পারবো। আমার মনে তখন আছিল- যাক কষ্ট হইলেও সন্তানগো খাওন দিতে হইবো, মানুষ করণ লাগবো। সেই জন্য আমি রিকশা চালানো বাইছা নিছি।’
স্মৃতি হাঁতরে ফাতেমা বলেন, ‘রিকশা চালাই অনেক বছর হইয়া গেছে গা। প্রায় ১১ বৎসর। ভাঙা রিকশা চালাইছি। তারাও (পাশের টং দোকানদাররা) জানে। ভাড়ায় চালাইতাম। এরপর ব্যাটারি রিকশা আমিই বাইর করলাম চট্টগ্রাম শহরে, চার-পাঁচ বছর আগে।’১১ বছর ধরে রিকশা চালানোর তথ্য শুনে অনেকেই চমবে উঠবে নিশ্চিত। কেউ কেউ হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না। কিন্তু ফাতেমার এসব কথায় সত্যতা নিশ্চিত করে সাক্ষী দিয়ে দিলেন যে পাশের দুই টং দোকানদার!, ‘হ...হ... চালাইছে, চালাইছে... অনেক বছর ধরে দ্যাখতাছি।’চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানার ওয়্যারলেস এলাকার বস্তির ছোট্ট একটি কক্ষে ফাতেমার বসবাস। ভাড়া দিতে হয় মাসে তিন হাজার টাকা। ওই বাসায় একা থাকেন ফাতেমা। তিন ছেলে থাকেন মামার বাড়ি কুমিল্লায়। সন্তান উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করানোর ইচ্ছা রয়েছে ফাতেমার। তিনি বলেন, ‘আমার তিনটা ছেলে লেখাপড়া করে। আল্লাহ বাঁচাইলে বড়টা সামনে মেট্রিক (এসএসসি) দিবো। একটা এইটে, আর একটা নাইনে। ওরা কুমিল্লায় মামার বাড়িতে পড়ে। আমি খরচা পাঠাই দি। আজকেও এক হাজার টাকা পাডান লাগবো।’চট্টগ্রাম শহরের প্রায় সব জায়গায় তিনি রিকশা চালান। রিকশা চালাতে দেখে কে কি বলে- প্রশ্নে ফাতেমার উত্তর, ‘কলেজের পুলারা সালাম দেয়। বলে খালাম্মা আসসালামু আলাইকুম। খালাম্মা ট্যাংকিউ। চালায় যান। আবার কয়েকডা আছে, রাস্তায় চলার সময় কইবো, এই মেয়ায় কি ভাড়া মারবো! এতে কোনো সমস্যা নেই। হুজুররাও উৎসাহ দেয়। পুলিশরাও ধরে না আমারে। সাইড দিয়া দেয়।’মাথায় ক্যাপ দিয়ে রিকশা চালান ফাতেমা খালা। এনিয়ে তার ব্যাখ্যা, ‘রোদ লাগে যে। মাথায় ধুল-বালু কম পরে। রোদ কম পরে। চট্টগ্রাম নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় গতকাল শনিবার সকাল ৯টায় এ আলাপ চলাকালে হাজির হন রেলওয়ের এক নিরাপত্তাকর্মী। ফাতেমাকে উদ্দেশে করে তিনি জানতে চান, জামাই কোথায়? উত্তরে নিজের রিকশাটি দেখিয়ে বললেন, জামায় এডা। এই যে স্বামী। এইডা আমার স্বামী। এইডা আমার ভাত দেয়।’
‘ফাতেমা খালার জন্য একটি রিকশা’ শিরোনামে ফেসবুকে একটি ইভেন্ট খুলেছিলেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সৃজিতা মিতু এবং সাংবাদিক মারজিয়া প্রভা। ইভেন্টের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের অনেকেই টাকা পাঠান ফাতেমা খালার জন্য। চলতি বছরের গত ১৭ জুন নগরীর চেরাগী মোড়ে ফাতেমার হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন রিকশা।এখন যেটি চালাচ্ছেন সেটি উপহার দেওয়া রিকশাটি কিনা, জানতে চাইলে একটু চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ফাতেমা, ‘মাইয়াগুলার গাড়িটা রাখতে পারলাম না, নিয়া গেছে। হিসাব রাখলাম, আজকে ২ মাস ১৩ দিন হইছে। অলংকার মোড়ে যাওয়ার কথা বলে ফিরিঙ্গিবাজার হতে তিনজন উঠল রিকশায়। একটার বয়স ৩০, আরেকটার ২৫, অন্যটার ১৮ হইবো। রাত নয়টা বাজে। আমবাগান পার হইয়া সেগুনবাগানের কাছে নীরব জায়গাটা আছে না, সেখানে যাওয়ার পর রিকশা থেকে তারা নেমে বলে, গাড়ি থেকে নাম। আমি যখন নামছিলাম না, তখন চুরি (ছুরি) বের করে বললো, ঢুকাই দিমু কইলাম... এরপর চাবি লই ফেলাইলো। আমি নামার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি টান দিয়া চইলা গেল।’এরপর অভিযোগ দিতে নিকটস্থ খুলশী থানায়ও যাননি ফাতেমা। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘থানায় গিয়া আর কী করুম। রিকশা না, তারা আমার কপালটাই নিয়া গেল। এক মাস ধরে টেনশনে আমার গাটা শুকায় গেছে। বেশি কষ্ট পাইতেছি বাবা। মাইয়াডা যে গাড়ি দিছে তারে কইছি না। যাক গাড়িডা বড় না, আমার জীবনডা বড়। মাইরা ফেলাইলে কী কইরতাম?’অনলাইনে গ্রুপ খুলে নতুন রিকশা কিনে দেওয়া দুই নারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল ফাতেমার কণ্ঠে, ‘মাইয়াগুলা আমার লাইগা অনেক কাটছে (খেটেছে)। কত মাইনষের কাছে যে গেছে। কত টিয়া উটাইছে... তয় গাড়ি কিনা দিছে। আল্লাহ মাইয়াগুলারে বাছাই রাহক। এখন রাতে আর গাড়ি চালাই না। সন্ধ্যা ৬টার আগেই বাসায় চলে যাই। জীবনডার দাম আছে।’
ফাতেমা বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাটারি রিকশা চালাই। প্রতিদিন মালিককে ৩০০ টাকা দিয়ে হাতে থাকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এতেই কোনোমতে চইলা যাইতাছে সংসার।’

No comments:

Post a Comment