Wednesday, October 12, 2016

সোনালি আঁশের সুদিন

dtl image
জাতীয় সংসদ ভবনের উল্টোদিকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই)। ক্যাম্পাসের মূল ফটক দিয়ে একটু সামনে গেলে দেখা যাবে সাদা রঙের নতুন একটি চার তলা ভবন। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও এটি একটি আন্তর্জাতিকমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বায়ো টেকনোলজি বিভাগের একটি পুরনো দোতলা ভবনকে সংস্কার করে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে এখানে পাট বিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্পর যাত্রা শুরু হয়। এ ভবনেই পাটের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাক ও দেশি পাটের জীবন রহস্যের উন্মোচনের মতো ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরআগে ২০১০ সালের ১৬ জুন জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর কাছে তোষা পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উদঘাটনের কথা জানান। এ কাজটি ‘জুট জেনোম সিকোয়েন্স’ শিরোনামে সরকারি তহবিল বরাদ্দের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে গবেষণার কাজটি শুরু হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাটের জন্য ক্ষতিকর এক ধরনের ছত্রাকের ‘জীবন রহস্য’ উন্মোচন হওয়ার খবর দেন। পাটের ‘জীবন রহস্য’ উন্মোচনের নেতৃত্বদানকারী হলেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক বাংলাদেশের মাকসুদুল আলম (প্রয়াত)। এরআগে তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা তোষা পাট ও পাটের জন্য ক্ষতিকারক এক ধরনের ছত্রাকের জেনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেন।
জেনোম সিকোয়েন্সের ঠিক আগের ধাপ ‘সঙ্করায়ণ’ নিয়ে কাজ করেছিলেন বিজেআরআই-এর সাবেক বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ শামসুল ইসলাম। তার এ গবেষণাটি প্রবন্ধ আকারে ১৯৬০ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘নেচার’-এ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব প্যান্ট টিস্যু কালচার অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি’তে তার নেতৃত্বে পাটের জিন ক্লোনিং নিয়ে প্রকাশিত হয় একটি গবেষণা প্রবন্ধ। তিনি বলেন, প্রযুক্তিগত সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে গবেষণারও অগ্রগতি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর সঙ্গে আমি যৌথভাবে পাটের জেনোম নিয়ে কাজ শুরু করি। আমাদের কাজটি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের। এরপর অধ্যাপক মাকসুদুল এ কাজটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দিলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাট পাট করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তান আমলে আমরা পাট নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছি, আন্দোলন করেছি। আমাদের পাটের টাকায় ইসলামাবাদ হয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর সরকার পাটের উন্নতিকল্পে কাজ করতে চেয়েছি। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও কাজ করে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে চাই।
২০১০ সালের জুন মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মাকসুদুল আলম বলেছিলেন, বাংলাদেশিদের জন্য পাট শুধু একটি আঁশ উৎপাদনকারী গাছ নয়। বরং এটা আমাদের জন্য জাতীয় প্রতীক। পাটের সঙ্গে আমাদের সোনার বাংলা ধারণার একটা যোগসূত্র আছে। সোনার বাংলা ঘিরে গড়ে উঠেছে আমাদের জাতিগত ঐতিহ্য, সেখানে ঢেউ খেলানো সোনালি ধানক্ষেত আর সোনালি আঁশ এ দুটি যেন আমাদের মুক্তির সন্ধান দেয়। এ কথাগুলো বলেছেন অস্ট্রেলিয়া নিবাসী জিন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী (যিনি এ প্রকল্পের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা) তার ‘সোনালি আঁশ’ লেখায়। পাট নিয়ে গবেষণার মূলমন্ত্র ছিল এ কথাগুলোই। দারুণ মেধাবী ও দেশপ্রেমী একটি দল পাট নিয়ে তাদের কাজ শুরু করেছে একদম সঠিক সময়ে।
পাটকে তুলার বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী করতে যে বাধা আছে তা আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এ বাধা দূর করাই এখন আমাদের কাজ। সুতা তৈরি করতে প্রতিবছর মোট চাহিদার ৯৭ ভাগ তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সুতা উৎপাদনের উপযোগী পাটের আঁশ উদ্ভাবন করা গেলে তুলা আমদানির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তিন বছর আগে আমাদের দেশে গবেষণায় তোষা পাটের জীবন নকশা উন্মোচন করার কাজ চলছিল। এমনকি অনেকাংশে সাফল্যও আসে। বাংলাদেশকে আর বিশ্ব অবহেলা করতে পারবে না। আশা করা যায়, আগামী ৫ বছরের মধ্যেই গবেষণার ফল কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
এদিকে পাট দিয়ে কাগজের কাঁচামাল ‘পাল্প’ তৈরির কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) এটি সম্ভব হলে ‘পাল্প’ রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে বাংলাদেশ। বর্তমানে সরকার পাটের ব্যবহার বাড়াতে পাটের প্যাকেজিংসামগ্রী আইন অনুমোদন করেছে। এ আইন অনুযায়ী খাদ্যশস্য, চিনি, সার, সিমেন্টের মতো পণ্য প্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। বর্তমানে প্রতিমণ পাট আড়াই হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে কৃষকরাও ভালো দাম পাচ্ছে।
পাটের বহুমুখীকরণে বাংলাদেশেই তৈরি হচ্ছে বেনারসি শাড়ি, জুতা ও জুতার সোল, জানালার বিলাসী পর্দা, কম্বল, সোয়েটার, জিন্সের প্যান্ট, পাঞ্জাবিসহ নানা পণ্য। সম্প্রতি ভারতের মতো পাট দিয়ে গাড়ির পার্টসও তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে ‘জুট ডাইভার ফিকেশন প্রমোশন সেন্টার’। দেশের বাইরেও এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় পাট রফতানি বেড়েছে ৭১ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৬.৭৩ ভাগ বেশি। একই সময়ে পাটজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে ১৮.৮১ ভাগ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন কাঁচা পাটের দাম ৪৩.৪১ ডলার এবং পাটজাত পণ্য ৫৮৭.২৫ ডলার। টয়োটা গাড়ির বডিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশের পাট।
বাংলাদেশ ও আগামী প্রজন্মের জন্য এটা অমূল্য সম্পদ। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাই এটা আবিষ্কার করেছেন। পাটে ‘লিগনিন’ অধিক মাত্রায় থাকায় বস্ত্রশিল্পে এর ব্যবহার সীমিত। বিজেআরআই উদ্ভাবিত ধবধবে সাদা আঁশের পাটের জাত চাষ করতে গিয়ে ছত্রাক আক্রান্ত হওয়ায় সাফল্যের মুখ দেখেনি। এ ছত্রাককে প্রতিহত করতে যে জিন দরকার সেটা ওই পাটে সন্নিবেশিত করলে তা রোগ মুক্ত হবে। তখন বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল হিসাবে পাটকে ব্যবহারের দ্বার হবে উন্মোচিত। এর ফলে ভালো জাতের পাটের ফলন বেড়ে যাবে। কৃষকরাও উপকৃত হবেন।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কামাল উদ্দিন বলেন, এখন ৫০ শতাংশ তুলার সঙ্গে ৫০ শতাংশ পাটের আঁশ মিশিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে। পাটের জেনোম সিকোয়েন্স হাতে পাওয়ায় এ গবেষণায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এভাবে অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যেই পাট ফিরে পাবে তার সোনালি অতীত।

No comments:

Post a Comment