অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে বিমান
গত ২০ বছরের মধ্যে বিমান লাভের মুখ দেখেছে মাত্র সাত বছর। ১৫টি উড়োজাহাজের মধ্যে এখন সচল রয়েছে ১৩টি উড়োজাহাজ। বাকি দুটির অবস্থা খুবই নাজুক। অবশিষ্ট ১১টি উড়োজাহাজ দিয়ে বিদ্যমান ১৫টি আন্তর্জাতিক ও সাতটি অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। প্রতিনিয়তই কাটছাঁট করতে হচ্ছে ফ্লাইট সিডিউল। আবার নির্দিষ্ট ফ্লাইটও ছাড়তে পারছে না সময়মতো। ফলে দিন দিন যাত্রী ভোগান্তি বাড়ছে। কমছে যাত্রীর সংখ্যাও। আর এভাবেই বছরের পর বছরের লোকসানেই থাকতে হচ্ছে বিমানকে।
বিমান সংশ্লিষ্টরা অবশ্য উড়োজাহাজের স্বল্পতা বা বিকল হয়ে থাকার পাশাপাশি বিমানের লোকসানের জন্য এ সেক্টরে কর্মরত অদক্ষ লোকবল ও অব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করেছেন। তাদের মতে, বিভিন্ন সময় বিমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছচারিতা ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি বিমানের লোকসানের বড় একটি কারণ। এ ব্যাপারে বিমান বিশেষজ্ঞ আবদুস সাত্তার বলেন, বিমানে উন্নতি না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, এ সেক্টরে যারা যে কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা সেই বিষয়ে কিছুই বোঝে না। শিক্ষার অভাব এবং সবকিছুতে দুর্নীতির প্রবণতা বিমানকে এতকাল ডুবিয়ে রাখা হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নন বিমানের চেয়ারম্যান এনামুল বারী। তিনি বলেন, বিমানের উন্নতি হচ্ছে না কথাটা শতভাগ ঠিক নয়। আগে কি হয়েছে, না হয়েছে জানি না; তবে আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সবকিছুতে স্বচ্ছতা আনার জোর চেষ্টা করছি। এখন আগের থেকে অনেক উন্নতি করেছে বিমান। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বিমান বাংলাদেশ এয়াললাইনস এ খোঁজ নিয়ে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বিমানের এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ‘আকাশে শান্তির নীড়’ নামে ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের সময় যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ বিমান। কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক হবে এবং দেশের সম্মান রক্ষা করবে। কিন্তু প্রায় ৪৪ বছর আগে শুরু করা বিমান তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। ডুবে ছিল লোকসান, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায়। শেষ পর্যন্ত লাভে আনতে ২০০৭ সালে কোম্পানিতে রূপ দেওয়া হয়। উন্নতি করতে নেওয়া হয় ব্যাপক পরিকল্পনা। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। বরং একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক রুট। ছোট হয়ে এসেছে বিমানের আকাশ।
সূত্রমতে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনস এর বহরে ১৫ টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি চলছে কোনমতে খুড়িয়ে, আর তিনটি অকেজো পড়ে রয়েছে। উড়োজাহাজ স্বল্পতার কারণে সর্বশেষ প্রায় ৮ হাজার হজ্জ যাত্রী পরিবহন করতে না পেরে হাতছাড়া হয়েছে বিমানের নিশ্চিত আয়। এর শতবাগ সুবিধা নিয়েছে বিদেশি উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো।
বিমানের আয়-ব্যয়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, গত ২০ বছরে বিমান লাভের মুখ দেখেছে মাত্র সাত বছর। এর মধ্যে ২০০৩-০৪ সালে তিন কোটি ৫০ লাখ, ২০০৭-০৮ সালে পাঁচ কোটি ৯১ লাখ এবং ২০০৮-০৯ সালে ১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং সর্বশেষ গত বছর বিমান লাভ করে ২৭১ কোটি টাকা। অবশ্য বিমান চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়েছিলেন চলতি বছর ৫০০ কোটি টাকা লাভ হবে। তবে সূত্র জানায়, সিডিউল বিপর্যয় ও যাত্রী কমে যাওয়ায় লাভ কিছুটা কম হলেও এ বছরও বিমান লাভে থাকবে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানের লোকসানের আরেকটি কারণ ‘বিমান লিজ নেওয়া’। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই বিমান কর্তৃপক্ষের। সূত্রমতে, এ বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেঘদূত ও মূয়ুরপঙ্খী নামে বিশ্বসেরা বোয়িং কোম্পানি থেকে কেনা বোয়িং ৭৩৭ ও বোয়িং ৮০০ উড়োজাহাজ দুটি উদ্বোধন করেন। এর পাশাপাশি আরো একটি বিমান লিজ নেয় বিমান কর্তৃপক্ষ। কথা ছিল এসব বিমান নিয়ে আরো ছয়টি নতুন আন্তর্জাতিক রুটে যাবে বাংলাদেশ বিমান। কিন্তু সে কথা পুরোপুরি রাখতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যন্ত বিমানে আন্তর্জাতিক রুট মাত্র ১৫টি। এর মধ্যে ইয়াঙ্গুন ও কলম্বো দুটি আন্তর্জাতিক রুট এ বছর চালু করে বিমান। আর ২০১৭ সালের পরিকল্পনায় রয়েছে আরও চারটি আন্তর্জাতিক রুট। এগুলো হলো নিউইয়র্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নারিতা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী দুই বছরের মধ্যে বিমানের লক্ষ্য ২৫টি আন্তর্জাতিক রুটে যাওয়া। বোয়িং কোম্পানির ছয়টি নতুন কেনা উড়োজাহাজ এখন বিমানের বহরে আছে। আরও চারটি নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত হবে বিমানবহরে। বিমানের গ্রাউন্ড সার্ভিসে বিদেশি পার্টনার সংযোগের কথা রয়েছে। সেটি হলে লাগেজ হ্যান্ডেলিংয়ে যাত্রী দুর্ভোগ থাকবে না। আর এয়ারক্রাফট হ্যান্ডেলিংয়েও বিমান হবে আন্তর্জাতিকমানের।
কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। সূত্র জানায়, বহরে মোট ১৫টি উড়োজাহাজের মধ্যে এখন সচল আছে মাত্র ১৩টি। ভাড়ায় আনা দুটি বোয়িং মাসের ১৫ দিন অচল থাকছে। বাকি ১১টি উড়োজাহাজ দিয়ে ১৫টি আন্তর্জাতিক ও ৭টি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে বিমান। এ অবস্থায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফ্লাইট কাটছাঁট করতে হচ্ছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় গত মাসে বিমান বহর থেকে বাদ দেয়া হয়েছে দুটি উড়োজাহাজ। এই দুটি উড়োজাহাজের আসন ছিল ২২০টি করে। এছাড়া চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় মঙ্গোলিয়া থেকে আনা একটি বোয়িং ৭৬৭ উড়োজাহাজও চলতি মাসে বহর থেকে বাদ পড়েছে। এর বাইরে মিসর থেকে লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজ মাসের অধিকাংশ সময় বিকল থাকছে। অনেকের মতে, এই উড়োজাহাজ দুটি এখন বিমানের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য মাত্র দুটি উড়োজাহাজ থাকায় প্রতিদিন সাতটি স্টেশনের ফ্লাইট সিডিউল ঠিক থাকছে না। গড়ে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা দেরি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলোতে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই অবস্থায় ফ্লাইট ও যাত্রী কমে যাওয়ায় বিমানের আয়ের অংকেও ব্যাপক ধস নেমেছে। এ অবস্থায় আয় বাড়াতে ও রুটগুলো সচল রাখতে আবারো উড়োজাহাজ লিজ নেয়ায় আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে বিমান। কিন্তু নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর কমিশন বাণিজ্যের কারণে উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো বিমানের কাছে জাহাজ ভাড়া দিতে চাচ্ছে না।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আবদুস সাত্তার বলেন, অবৈধ আয়ের সবছেড়ে বড় বাণিজ্য হচ্ছে লিজ বিমান। একটা শ্রেণি বারবার বিমান লিজ নেয়ার জন্য তোড়জোড় করে। কিন্তু কেন লিজ নিতে হবে। লিজের টাকায় যদি নতুন বিমান কেনা যায় তাহলে সমস্যা কোথায়। আসলে ৭ বছর দায়িত্বপালনকালীন বিমানের সাবেক চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন সাহেব বিমানটাকে শেষ করে দিয়েছেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুটি উড়োজাহাজকে গ্রাউন্ডেড করার পর বহরে নতুন দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ শিগগিরই ভাড়া নেয়ার কাজ শুরু করেছে। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন পেলে আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে বিমান বহরে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের দুটি উড়োজাহাজ যুক্ত হবে বলে জানান বিমান বাংলাদেশের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ। তিনি বলেন, এটি পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বর্তমানে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর মডেলের চারটি, বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের দুটি, বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের চারটি, ড্যাস মডেলের দুটিসহ মোট ১২টি বিমান রয়েছে।
বিমানকে লাভজনক করতে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন বিমান সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমান এয়ারলাইনস এর এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বিমান সিডিউল ঠিক রাখতে পারছে না। সরকার ইচ্ছা করলে বিমানকে লাভজনক করতে পারে। সে জন্য দরকার বিদেশি অনুদান। আর বিমানে দুর্নীতির ও অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে বিমান শত শত কোটি টাকা হারাচ্ছে আর প্রাইভেট ও বিদেশি বিমানগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করে নিচ্ছে।
অবশ্য বর্তমানে বিমান ব্যবস্থাপনায় কিছুটা হলেও দক্ষ লোকবল রয়েছে মন্তব্য করে বিমান বিশেষজ্ঞ আবদুস সাত্তার বলেন, বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ভালো লোক। তারা বিমানটাকে বুঝতে শিখেছে। আগে কেউই তা করেনি। আমরা দুই লাখ কোটি টাকা দিয়ে বিমান বন্দর তৈরি করার চিন্তা করি, অথচ এই আন্তর্জাতিক শাহজালাল বিমানবন্দর এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। লিজে বিমান এনে বারবার ঠিক করবে আর ইনকাম করবে—এ প্রবণতা কমাতে হবে। এখন ফুয়েলের দাম কম হওয়ায় বিমান লাভের মুখ দেখছে। এ বিমান ভবিষ্যতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। তবে এর জন্য দরকার যারা বিমানকে বোঝে তাদের দিয়ে চালানো।
No comments:
Post a Comment