Tuesday, November 7, 2017

সংকট সমাধানে প্রয়োজন সমঝোতা  

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আভাস


একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে নির্বাচনী রাজনীতিতে গতি-প্রকৃতির বদল হচ্ছে প্রতি সপ্তাহেই। রং বদলাচ্ছে রাজনীতির। সব দলের অংশগ্রহণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে কখনো আশা জাগছে আবার কখনোবা দেখা দিচ্ছে নিরাশাও। এক সপ্তাহ আগেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলাকে কেন্দ্র করে রাজনীতি যতটা গুমোটের দিকে যাচ্ছিল, গত এক সপ্তাহে, বিশেষ করে এই সপ্তাহের শেষের দিকে সেখানে ইতিবাচক কিছু আভাস মিলেছে। নির্বাচন নিয়ে আশাব্যঞ্জক তথ্য মিলেছে।
গত এক সপ্তাহের রাজনীতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক মহলের পক্ষ থেকেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকেও কিছুটা নরম সুরেই কথা বলতে শোনা গেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের অনেক বেশি সংযত থাকতে দেখা গেছে।
সর্বশেষ ৭ নভেম্বর উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে যে উত্তাপ ছড়ানোর আশঙ্কা ছিল, ‘সমাবেশের অনুমতির আশ্বাস পাওয়া গেছে’—দলের পক্ষ থেকে এমন তথ্য জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে সেই উত্তাপ কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীনদের অনেক বেশি সংযত মনে হচ্ছে। তেমনি ৭ নভেম্বর সংসদ ভবনে চলমান সিপিএ সম্মেলন উপলক্ষে নিরাপত্তার কারণে বিএনপিকে জিয়ার মাজারে যেতে না দেওয়া হলেও দলের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। এর আগে গত ২ নভেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেছেন, যত প্রতিকূল পরিবেশই আসুক না কেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে যাবে। এমনকি এই সরকার বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হবে বলেও জোর দিয়েছেন তিনি। এর প্রত্যুত্তরে পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আগামী নির্বাচনে যদি না আসে, তাহলে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। এমনকি খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিহিংসামূলক কোনো কর্র্মসূচিতে যায়নি। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত, তা রাজনীতির ভাষায় ‘সংযত আচরণ’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে গত এক সপ্তাহে দেশি-বিদেশি কূটনীতিতেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসেছে। গত ২ নভেম্বর ‘জাতিসংঘ সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়’ বলে মন্তব্য করেছেন সংঘের বিদায়ী আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্স। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের সুবাতাস বইছে। জাতিসংঘ প্রত্যাশা করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি কেবল অংশগ্রহণমূলক নয়, এটি অবাধ এবং সুষ্ঠু হবে। এরপর গত সোমবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যাননের কাছেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে শর্ত হিসেবে বিদ্যমান সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন দলের নেতারা।
চলমান রাজনীতির এমন প্রেক্ষাপটকে আগামী নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক আভাস বলে মনে করছেন নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনীতিতে কিছুটা হলেও আশা জেগেছে। সরকার বলছে, তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। বিএনপিও যেতে চাইছে নির্বাচনে। এখন প্রশ্ন হলো নির্বাচন ঘিরে দেখা দেওয়া বিতর্কের সমাধান কীভাবে হবে। সেটা ভাবতে হবে সবাইকে। সংকট সমাধানে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
প্রশ্ন উঠেছে-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মূল দুই ইস্যুতে দেখা দেওয়া সংকটের সমাধান হবে কী করে? একদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, বিদ্যমান সংসদ ভেঙে দিয়ে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। ফলে নির্বাচনের জন্য চলমান রাজনীতিতে যে ইতিবাচক আভাস মিলছে, সেটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে তো?—এমন প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, সংকট সমাধানে প্রয়োজন সমঝোতা। আলোচনা দরকার। এখন যে প্রেক্ষাপট তাতে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন সম্ভব এবং সেটিই হবে। কিন্তু সব দলকে নির্বাচনে আনতে হলে আলোচনা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। তবে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও ভূমিকা নিতে হবে।
অবশ্য গত ১৪ অক্টোবর শনিবার সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনিবাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথসভার শুরুতেই দেওয়া প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ মিলেছে। সেদিন তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, আমরা সেটাই চাই। আগামীতে নির্বাচন হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে হয় আলোচনা করে তার একটা পথ বের করব। আমরা চাই, মানুষ মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করবে। যার যার প্রতিনিধি সে সে বেছে নেবে।’
বর্তমান রাজনীতিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন। তিনি বলেন, কিছু নেতিবাচক ঘটনা থাকলেও রাজনীতিতে সমঝোতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে; যা আমাদেরকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণমূলক হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী করে তুলছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দল সবাই চাচ্ছে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে ও সমঝোতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হোক। সরকার থেকেও এ বিষয়ে বলা হয়েছে ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিএনপিও নির্বাচনে অংশ নেবে বলেই দলটির বিভিন্ন নেতার বক্তব্যে মনে হচ্ছে। নির্বাচন হতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পাবে বলে বিএনপি একটা আশ্বাস পেয়েছে, যা অবশ্যই রাজনীতিতে ইতিবাচক। আমিও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হওয়া উচিত। এই নির্বাচন বিশ্লেষক আরো বলেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে বর্তমানে যে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা ধরে রাখতে প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে রাজনীতিবিদদের আন্তরিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির প্রধান তিন দাবি অসাংবিধানিক। এর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে ও ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) উপ-অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বলা হয়েছে-বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে সহায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো কাঠামো নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ কী হবে, কারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন বা থাকবেন না; তা নির্ধারণের একমাত্র অধিকার প্রধানমন্ত্রীর।
একইভাবে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ অবসানের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার এখতিয়ার কারো নেই বলেও জানিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। এই বিধানের কারণে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশনকে আরেকটি সংসদ নির্বাচন করতে হবে। তবে ওই সময় সংসদের অধিবেশন বসবে না।
এমনকি নির্বাচনের আগে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের যে দাবি করেছে, সংবিধানে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে সংবিধানে বলা আছে, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিনের মধ্যে। ফলে সরকারের পদত্যাগের প্রশ্ন ওঠে না। কোনো কারণে যদি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগও করেন তাহলেও সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আস্থাভাজন কাউকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
তবে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনী পরিবেশকে সমঝোতামূলক করতে দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা। সংসদের বাইরের দল বিএনপি দুর্বল অবস্থানে আছে। তারা নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতা চাইছে বলে মনে হচ্ছে। সরকারি দলকেও চাইতে হবে। বর্তমানের পরিবেশকে আরো সুন্দর করতেও তা দরকার। রাজনীতিবিদরা চাইলে পরিবেশ আরো সুন্দর হবে, তারা না চাইলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে বলে আমি মনে করি। তখন আমরা আরো সংকটের দিকে এগিয়ে যাব। আশা করি, সব দলের রাজনীতিবিদের মধ্যে এ বোধোদয় ঘটবে।
লেখকঃ প্রতীক ইজাজ 

No comments:

Post a Comment