জীবন সংগ্রামী রোজিনার গল্প

রোজিনা এখন একাগ্রতার সঙ্গে কেঁচো সার উৎপাদনের কাজ করে চলেছেন। দিনমজুর স্বামীর সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। বিয়ের দুই বছরের মধ্যে তার দুটি সন্তান জন্ম নেওয়ার পর খরচ আরো বেড়ে যায়। সংসারের অভাব ঘোচাতে প্রতিবেশী এক নারীর কাছ থেকে সেলাইয়ের কাজ শিখেন তিনি। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি সেলাইমেশিন কিনেন। এর মধ্যে স্বামী কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে সেলাইমেশিনটি বিক্রি করে দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা করান। দিনমজুর স্বামী রোজগারে অক্ষম হয়ে পড়লে দুই সন্তানসহ সংসারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান রোজিনা।
২০১২ সালে রোজিনা দি হাঙ্গার প্রজেক্টের তিন দিনের উজ্জীবক প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৪ সালে কেঁচো (ভার্মি) কম্পোস্ট সার উৎপাদনের ওপর তিন দিনের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে পাঁচটি কেঁচো দেওয়া হয়। বাড়িতে নিয়ে এসে লোকলজ্জার ভয়ে ওই কেঁচোগুলোকে গোয়ালঘরে তুলে রাখেন। এর এক মাস পর তিন ব্যক্তি তার বাড়িতে গিয়ে ওই কেঁচো পাঁচটি কিনতে যান। তিনি ২১ টাকায় বিক্রিও করে দেন। এ সময় হঠাৎ তার মনে খটকা লাগে। উনারা (তিন ব্যক্তি) এত দিন পর কেন কেঁচো কিনতে আসলেন? এই কেঁচোর ভেতর নিশ্চয় কিছু আছে, এমনি ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দৌড়ে গিয়ে তাদের কাছ থেকে বিক্রি করা কেঁচো নিয়ে নেন। এরপর প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কেঁচো সার উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করলেন তিনি। শুরু করেন কঠোর পরিশ্রম, নেমে পড়েন নতুন করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। পাঁচটি কেঁচো একটি মাটির বড় পাতিলে (স্থানীয় ভাষায় নান্দা) প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সার উৎপাদনে পরিচর্যা শুরু করেন। এখন পাঁচ কেঁচো থেকে বৃদ্ধি পাওয়া অগণিত কেঁচো ১০টি নান্দায় রেখে ২০ দিন পর পর প্রায় তিন মণ সার উৎপাদিত হয়। বর্তমানে স্থানীয়সহ দূর-দূরান্তের কৃষকের মাঝে এই সারের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় কৃষক কামরুজ্জামান মিলন বলেন, প্রতি কেজি সার ২০ টাকা ও প্রতিটি কেঁচো তিন টাকা দরে বিক্রি করে মাসে এখন রোজিনার আয় প্রায় ৬ হাজার টাকা। পাশাপাশি জমি লিজ নিয়ে ফসলের আবাদসহ হস্তশিল্পের কাজ করেও রোজিনা বেশ রোজগার করে থাকেন; যা দিয়ে সংসারের খরচসহ দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। রোজিনা নিজ গ্রামের পিছিয়ে পড়া হতদরিদ্র নারীদের আর্থসামজিক উন্নয়নে ‘হাসনা হেনা গবেষণা সমিতি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তিনি পিছিয়ে পড়া নারীদের মধ্যে মা ও শিশুর পুষ্টি, ছাত্রছাত্রীদের ঝরে পড়া ও স্যানিটেশন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশুদের শতভাগ স্কুলে ভর্তি এবং বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতন বন্ধে প্রচারাভিযান ও উঠান বৈঠক পরিচালনা করেন। এভাবে সূর্য ওঠার পর থেকে সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করেন রোজিনা।
একদিন অভাব-অনটন ছিল যার নিত্যসঙ্গী। দিনমজুর স্বামীর সংসারে মোটা কাপড় পরা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। যেখানে স্বামীর পক্ষে স্ত্রী-সন্তানদের মুখে দুই বেলা দুই মুঠো অন্ন জোগাড় করাই ছিল চরম কষ্টের। এমনি এক দুঃসময়ে পরিবারে সচ্ছলতা আনতে কঠিন বাস্তবতার মুখে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়েন যশোরের মণিরামপুরের অজপাড়া গাঁয়ের আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামী নারী রোজিনা খাতুন। কেঁচো সারেই ভাগ্যবদল করেছেন তিনি। পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যখচিত হস্তশিল্পের কাজ করেন তিনি। রোজগার করেন পরিবারের জন্য বাড়তি আয়। এখন রোজিনা কারো মুখাপেক্ষী নন। নিজেই হয়েছেন স্বাবলম্ব^ী। তার দেখাদেখিতে এলাকার অন্য নারীরাও এ কাজে এগিয়ে এসেছেন। তারাও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন রোজিনার কাছ থেকে। ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ থাকলেও পিতার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় রোজিনা খাতুনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। ২০০০ সালে বিয়ে হয় একই উপজেলার দত্তকোনা গ্রামের শফিকুল ইসলামের সঙ্গে।
সার উৎপাদন শুরু হলেও বাজারজাত করানো নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোজিনাকে। তার পরও দমেননি তিনি। উৎপাদিত সার নিজের মাত্র সাড়ে চার কাঠা ধানের জমিতে প্রয়োগ করে কাঠাপ্রতি তিনি প্রায় আড়াই মণ ধানের ফলন পান। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। খবর পেয়ে এগিয়ে আসে উপজেলা কৃষি অফিস। রোজিনার কেঁচো সার বাজারজাতকরণে বিভিন্ন মাঠদিবসসহ কৃষি-সংশ্লিষ্ট কর্মশালায় এই সারের কার্যকারিতা নিয়ে এখন কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়।
No comments:
Post a Comment